সরকারের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে হেফাজতে ইসলামের বিবৃতি
সরকারি প্রেস নোট সত্য, স্বচ্ছতা ও দায়বোধবর্জিত
সংগ্রাম রিপোর্ট : মতিঝিল শাপলা চত্বরে বর্বরোচিত গণহত্যার পাঁচদিন পর প্রদত্ত সরকারি প্রেস নোট প্রত্যাখ্যান করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এক যুক্ত বিবৃতিতে গতকাল প্রেস নোট প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ঘটনার সময় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও দুটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করাসহ বিভিন্ন রহস্যজনক কর্মকা- এবং সেদিন প্রকৃতপক্ষে কত লোককে হত্যা করা হয়েছে তার পরিসংখ্যান সরকারকেই দিতে হবে।
হেফাজত নেতৃবৃন্দ যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, শাপলা চত্বরে ইতিহাসের বর্বরোচিত, নিকৃষ্টতম গণহত্যার ৫ দিন পর বিভিন্ন মহলের চাপের মুখে সরকার একটি দায়সারা গোচের প্রেস নোট দিলেও এতে বস্তুনিষ্ঠ কোনো তথ্য, গ্রহণযোগ্য বক্তব্য কিংবা ইতিবাচক কোনো কথা স্থান পায়নি। সত্য, স্বচ্ছতা ও দায়বোধবর্জিত এই প্রেস নোটে সরকারের ধারাবাহিক মিথ্যাচারের প্রতিফলন ঘটেছে। সরকারের একেকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি পরস্পর বিরোধী নানা রকম বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে প্রকৃত সত্য আড়াল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। সংগত কারণে জনগণ এই প্রেস নোট প্রত্যাখ্যান করেছে। সরকারি প্রেস নোটের বিভিন্ন পয়েন্টের জবাবে হেফাজত নেতৃব্ন্দৃ বলেন : সম্পূর্ণ দলীয় বিবৃতির আদলে লেখা এই প্রেস নোটে সেদিনের অভিযানে কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহৃত হয়নি বলে যে মিথ্যা দাবি করা হয়েছে; তার জবাবে আমরা বলতে চাই, যদি যৌথবাহিনীর অভিযানে কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা না হয় তাহলে দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্টে ৫৬ জন, দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় ১৩ জন লোকের মৃত্যু কীভাবে হল? মিডিয়ার সামনে ডিএমপি কমিশনার ১১টি লাশ পাওয়ার স্বীকারোক্তি কীভাবে দিলেন ?
তা-ব ও জ্বালাও পোড়াও সম্পর্কে হেফাজতে ইসলাম ইতোমধ্যে সুস্পষ্টভাবে মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসীকে জানিয়েছেন যে, হেফাজতে ইসলামের কোনো নেতা-কর্মী এসব কর্মকা-ে কোনোভাবেই জড়িত ছিল না। বরং হেফাজতের ঈমানী আন্দোলনকে জাতির সামনে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য একটি মহল পুলিশের সামনে এসব অপকর্ম ঘটিয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদেরকে প্রতিহত করেনি। 'ব্যাংক লুটের পরিকল্পনা' সম্পর্কিত প্রেস নোটের বক্তব্য মিথ্যা, কাল্পনিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমাদের প্রশ্ন; গোয়েন্দাদের কাছে যদি ব্যাংক লুটের সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকে এতোগুলো নিরীহ, নিরস্ত্র আলেমদের উপর সরকারি গু-া বাহিনীর আক্রমণ, হত্যা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যে পাশবিক নৃশংসতা ঘটানো হল এ বিষয়ে কোনো তথ্য কেন ছিল না ? সরকার কী জবাব দেবেন যে, সেদিন রাতে কেন বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল ? কেন পুরো এক মাইল এলাকায় কয়েকটি চিহ্নিত মিডিয়া ছাড়া সংবাদকর্মীদের ঢুকতে দেয়া হয়নি? পুলিশের পোষাক পরে ঘুমন্ত আলেমদের ওপর এই বর্বরোচিত আক্রমণ কারা করেছিল? এদের পরিচয় কীÑ সরকারকেই জানাতে হবে? হেফাজতে ইসলাম যদি সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে থাকে তাহলে সেদিন রাতে শাপলা চত্বরে কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বা সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হলো না কেন ?
সরকারের উদ্দেশে হেফাজত নেতৃবৃন্দের প্রশ্ন, অভিযানের আগেই কেন এতো ট্রাক, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ি জমায়েত করা হয়েছিল ? হাজারো আলিম ও নবীপ্রেমিক তাওহীদি জনতার রক্তে যখন মতিঝিল-শাপলা চত্বর রঞ্জিত হয়েছিল, মিডিয়া ও দেশবাসী দেখার আগেই ভোররাতে কোন্ উদ্দেশ্যে তা পরিষ্কার করা হল? তড়িঘড়ি করে শহীদদের লাশ কোথায় সরিয়ে নেয়া হল? সরকারকে জনগণের কাছে এসব প্রশ্নের জবাব অবশ্যই দিতে হবে।
বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, আরামবাগ, দৈনিক বাংলামোড় থেকে যৌথবাহিনীর আক্রমণের সময় ইত্তেফাক মোড় দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় রাস্তায় ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দিয়ে হেফাজত কর্মীদের উপর আক্রমণ করার সুযোগ কেন করে দেয়া হলো? বার বার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিষয়টি অবহিত করার পরও কেন সরকার দলীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা হল না? হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ থেকে মাইকে বার বার ঘোষণা হচ্ছিল যে, 'সন্ধ্যা থেকেই সমাবেশের চতুর্পাশ থেকে হামলা হচ্ছে এবং এশার পূর্বেই ১৬টি তাজা প্রাণ শাহাদাত বরণ করেছেন। এমতো পরিস্থিতিতে আমরা সমাবেশ সমাপ্ত করলে ফেরার পথে রাতে বিভিন্ন স্থানে নেতাকর্মী ও আলেম-ওলামার ওপর ব্যাপক হামলা হবে। বিধায় ফজরের নামাযের পর আমীরে হেফাজত আল্লামা শাহ আহমদ শফী এসে দোয়ার মাধ্যমে সমাবেশ শেষ করবেন।' কিন্তু আমাদেরকে সেই সুযোগ না দিয়ে কেন রাতের অন্ধকারে আচমকা সশস্ত্র আক্রমণ ও বৃষ্টির মতো গুলী বর্ষণ করে এতোগুলো লোককে হত্যা, আহত ও পঙ্গু করা হলো? এসব নিরীহ আলেমদেরকে কী এদেশের নাগরিক মনে করা হয়নি? শত শত মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, অনেক সন্তানকে এতিম ও নারীকে বিধবা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হৃদয়ে কী ন্যূনতম মানবতাবোধ বলতে কি কিছু নেই?
নেতৃবৃন্দ বলেন, গুলিস্তান, জিরোপয়েন্ট, পল্টন, বায়তুল মোকাররম উত্তর গেইট থেকে দৈনিক বাংলামোড় পর্যন্ত পুরো এলাকা সম্পূর্ণভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের দখলে ছিল। তাদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে ওখানে হেফাজতের কোনো নেতাকর্মীর দাঁড়ানোর উপায় ছিল না। এসব এলাকায় পুলিশ বেস্টনীতে ফুটপাতের দোকানে আগুন, পবিত্র কুরআন শরীফ ও বই-পুস্তক পোড়ানোর মতো জঘন্য ঘটনা কারা ঘটিয়েছে কালের কণ্ঠ, মানবজমিন, ইনকিলাবসহ কয়েকটি পত্রিকায় তার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এর আলোকে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশের করিৎকর্মা পুলিশ যারা সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকারীদের এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করতে পারেনি তারা কীভাবে ৫ মে'র দিনগত রাতের শত শত শহীদের লাশ দাফনের পূর্বে এবং ঘটনার ১২ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলার হেফাজত নেতৃবৃন্দের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে হত্যা মামলাসহ ১৮টি মামলা দায়ের করতে পারেÑ তা সচেতন ও বিবেকবান মানুষের জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা। সরকার যদি একেবারে কিছুই না করে থাকে তাহলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর সুবাদে দেশের জনগণ ও বহির্বিশ্ব কী দেখতে পেল? জাতিসংঘ, ওআইসি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক মানববাধিকার সংস্থাগুলোর উদ্বেগ, নিন্দা ও প্রতিবাদের কী কারণ থাকতে পারে। সরকার জবাব দেবেন কী?
হেফাজত নেতৃবৃন্দ বলেন, বিএনপি-জামায়াতের ও ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে আমাদের কোনো ধরনের যোগাযোগ ছিল না। সরকার হেফাজতে ইসলামের ঈমানী আন্দোলনকে বিরোধী জোটের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের ইসলামবিরোধী নাস্তিক্যবাদী অবস্থান জাতির কাছ থেকে আড়াল করতে চায়। তারা প্রশ্ন করেন, সরকার যদি হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবিগুলো মেনে নিতেন তাহলে কোটি কোটি তাওহিদী জনতার সমর্থন তো সরকারের পক্ষেই থাকতো। সরকার তাওহিদী জনতার সেন্টিমেন্টকে নিজেদের পক্ষে না নিয়ে ধাক্কা মেরে বিরোধী জোটের দিকে ঠেলে ও বামপন্থীদের কু-মন্ত্রণায় দেশে গৃহযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করে বিদেশী এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে এগুচ্ছে।
হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ বলেন, মিথ্যা প্রেস নোট দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করে আন্দোলন নস্যাৎ করা যাবে না। শত শত আলেম-হাফেজের রক্তে যে সরকারের হাত রঞ্জিত হয়েছে; আল্লাহর জমিনে একদিন তাদের বিচার অবশ্যই হবে। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে, সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দিয়ে হামলা করে সরকার দেশকে আলেমশূন্য করতে চায়। মাদরাসা বন্ধ করে মসজিদের ইমাম-খতিবদের জুমা পড়াতে বাধা দিয়ে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আলেম-ওলামা ও মাদরাসা ছাত্রদের হয়রানি করে এদেশে স্পেনের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করে সেক্যুলার-নাস্তিক্যবাদী আদর্শ বাস্তবায়নের স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে না। প্রয়োজনে লাখ লাখ নবীপ্রেমিক তাওহিদী জনতা রক্ত দেবার জন্যে প্রস্তুত রয়েছে।
বিবৃতিদাতা নেতৃবৃন্দরা হলেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, নায়েবে আমীর মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ, মাওলানা শামসুল আলম, মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, মাওলানা আবদুল হামিদ পীর সাহেব মধুপুর, মাওলানা মুফতি মোজাফফর আহমদ, মাওলানা আবদুল মোমেন শায়খ ইমামবাড়ী, মাওলানা আবদুল মালেক হালিম, মাওলানা হাফেজ তাফাজ্জুল হক, মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী, মাওলানা হাফেজ তাজুল ইসলাম, মাওলানা আশরাফ আলী বিজয়পুরী, মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা সালাহুদ্দিন নানুপুরী, মাওলানা সলিম্ল্লুাহ, মাওলানা জুনাইদ আল হাবিব, মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ ফয়েজুল্লাহ, মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী, মাওলানা লোকমান হাকিম, মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ, মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা মনজুরুল ইসলাম, মুফতি মুহাম্মদ তৈয়্যব প্রমুখ।
http://www.dailysangram.com/news_details.php?news_id=116176
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment