Sunday, September 14, 2025
আন্দামানে বাঙালি,বাংলা ও বাঙালির সর্বনাশ করেছেন বাঙালি নেতারা
আন্দামানে বাঙালি
2011 সালের জনগণনা অনুযায়ী আন্দামানে 64 হাজার বাঙালি। এরা বেশির ভাগ ভারত বিভাজনের ফলে পূর্ব বঙ্গের ছিন্নমূল তফসিলি নমশূদ্র ও পৌন্দ্র ক্ষত্রিয় বাঙালি।১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের ফলে মানবজাতির ইতিহাসে জোরপূর্বক অভিবাসনের অন্যতম প্রধান ধারা শুরু হয়।
দেশভাগের ইতিহাসের প্রভাবশালী আখ্যানগুলিতে মূলত পাকিস্তান থেকে ভারতে অভিবাসনকারী হিন্দুদের একটি ঢেউ এবং পাকিস্তানে পৌঁছানোর জন্য ভারতীয় সীমান্ত পেরিয়ে মুসলিম অভিবাসীদের একটি বিপরীত ধারা হিসেবে এই দেশত্যাগকে বর্ণনা করা হয়েছে। দেশভাগের সত্তর বছর পরেও, ক্ষতি এবং বাস্তুচ্যুতির দীর্ঘ প্রতিধ্বনি এখনও অনেকের জীবনে প্রভাব ফেলছে এবং দেশভাগের খোলা ক্ষতের বেশ কয়েকটি বিকল্প ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি। এই
বিধান রায়ের পূর্ব 1949 সালে ভারত সরকার তিনটি পুনর্বাসনের প্রকল্প অনুমোদন করে। নৈনিতাল, দণ্ডকারণ্য ও আন্দামান। আন্দামানে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। বাংলা ও ভারত সরকারের প্ল্যান যদি সফল হত তাহলে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার পরে আন্দামান হত বাঙালি প্রধান রাজ্য।
আমার বাবা উদ্বাস্তু নেতা পুলিন বাবু তখনই দাবি করেন এই তিনটি প্রকল্পের যে কোন একটিতে পুব বাংলার সমস্ত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হোক।বাংলার বাইরে আর একটি বাংলা হলে মাতৃভাষা বাংলা, বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পুব বাংলার তাফসিলিদের রাজনৈতিক শক্তি বিস্তার হবে।বাংলার বর্ণহিন্দু নেতৃত্ব এই দাবি মানতে নারাজ হয়, তাঁরা পত্র পাঠ তিনটি প্রকল্পই বাতিল করে।
1950 সালে মুখ্যমন্ত্রী হন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়।তিনি পুব বঙ্গের ছিন্নমূল মানুষদের উদ্বাস্তু মানতে অস্বীকার করেন।তাঁর নিদান ছিল, এই উদ্বাস্তুদের বাংলা এবং আসামের চা বাগানের কুলি করা হোক।সেই অনুযায়ী কুলি কার্ড শুরু হয়। পুলিন বাবু তীব্র বিরোধিতা করে শিয়ালদহ, রানাঘাট ও শিলিগুড়িতে আন্দোলন শুরু করেন,আমরা চাষী, আমাদের চাষের জমি দিতে হবে।
বাংলার বাইরে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের বাদ সাধে বামেরা। এরা উদ্বাস্তুদের ভূল বোঝাতে শুরু করে যে কালাপানিতে পাঠানো হচ্ছে। এদের জন্যেই আন্দামানের বদলে পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তুদের উত্তর প্রদেশ, ওড়িশা,মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিসগড়ে পুনর্বাসন করা হয়। উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্ত নৈনিতালে তারাইয়ের জঙ্গলে শুধু বাঙালিদের বসাতে চেয়ে ছিলেন,কিন্ত বামেদের জঙ্গল, বাঘ ও প্রচন্ড শীত নিয়ে তৈরি আশঙ্কায় উদ্বাস্তুরা নৈনিতালে আসতে অস্বীকার করে।মাত্র আড়াই হাজার পরিবার 1951 পর্যন্ত দিনেশপুরে আসেন,ফলে নৈনিতালে পাঞ্জাবি,শিখ উদ্বাস্তু ও উত্তর প্রদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বসতি তৈরি হয়। 1959 সালে শক্তি ফার্ম আবাদ হয় বাঙালি উদ্বাস্তুদের দিয়ে।কিন্তু বাঙালিরা এখানেও সংখ্যালঘু হয়ে যায়,যেখানে আর একটি বাংলা হতে পারত।
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, পশ্চিমে ভারত, এবং উত্তর ও পূর্বে মিয়ানমার কে রেখে বঙ্গোপসাগরে মধ্যে দ্বীপপুঞ্জ গঠন করেছে। বেশিরভাগ দ্বীপগুলি ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অংশ, এই দ্বীপপুঞ্জর উত্তরে কোকো দ্বীপপুঞ্জ সহ অল্প সংখ্যক দ্বীপ মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্ত।
আন্দামানে বসবাসকারী সমগ্র বাঙালি সম্প্রদায়ের আনুমানিক ৯৮% বাঙালি বসতি স্থাপনকারী এবং তাদের বংশধরদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। ঔপনিবেশিক যুগ থেকে, দ্বীপপুঞ্জগুলি বিভিন্ন বর্ণ, ভাষা, ধর্ম এবং জাতিগত মানুষের আবাসস্থল হয়ে ওঠে: উপমহাদেশের রাজনৈতিক বন্দী, বিদ্রোহীদের নির্বাসিত সম্প্রদায়, বার্মিজ সংখ্যালঘু, শ্রীলঙ্কান তামিল , রাঁচি থেকে নিয়োগ করা উপজাতি শ্রমিক এবং বনের আদিবাসীদের ধ্বংস করা। যদিও দ্বীপপুঞ্জের বৈচিত্র্যময় বহু-জাতিগত সমাজকে প্রায়শই 'ক্ষুদ্র ভারত' এবং 'বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের' প্রতীক হিসাবে বর্ণনা করা হয়, তবুও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা এবং কমবেশি অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব রয়েছে। এই বৈচিত্র্যময় সামাজিক পরিসরের মধ্যে, পুরাতন বাঙালি বসতি স্থাপনকারীরা নিজেদেরকে প্রান্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে উপলব্ধি করে।
উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে বাঙালি নেতাদের শত্রুতাপূর্ন আচরনের ফলে তফসিলি বাঙালিদের বাংলার ইতিহাস ভূগোল থেকে বহিষ্কৃত করে বাংলার বাইরে বাইশটি রাজ্যে তাঁদের জলে, জঙ্গলে, পাহাড়ে, মারিভূমি, দ্বীপে ছড়িয়ে দিয়ে তাঁদের মাতৃভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ছিনিয়ে নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও সংরক্ষণ ছিনিয়ে নেওয়া হল। ফলে আজ উত্তরাখণ্ড, উত্তর প্রদেশ,মধ্য প্রদেশ,ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, অসম, ছত্তিসগড়ে শুধু না বিহার, ঝাড়খন্ডের মত রাজ্যে, মোট বাইশটি রাজ্যে বাঙালিরা নামেই বাঙালি। তিন প্রজন্মে ভাষায় হিন্দির ছাপ পড়েছে। আর দুই প্রজন্মে এরা আর ভাষাতেও বাঙালি থাকবে না।
বাংলায় কত বাঙালির বাস?
বাংলার বাইরে বাইশ কোটি বাঙালির মাতৃভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, নাগরিকত্ব ও মানবাধিকার শেষ করে দিলেন যারা, মরিচ ঝাঁপি গনহত্যা ঘটালেন যারা তাঁরা কোন মুখে মাতৃভাষা ও অস্তিত্ব সংকটের দোহাই দেন?
অন্যদিকে শ্রীলংকা থেকে আসা তামিল উদ্বাস্তুদের পরে আন্দামানে পাঠায় ভারত সরকার। আজ আন্দামানে বাঙালিদের থেকেও তামিলদের দাপট বেশি। বাঙালিদের ওখানে 1960 এর পরে পাঠানো হয়।সেদিন যদি বামেরা ঝামেলা না করত তাহলে আজ আন্দামান বাঙালি রাজ্য হিসাবে পরিচিত হত।
ভারত বিভাজনের পর পূর্ববঙ্গ (বাংলাদেশ) থেকে হাজার হাজার বাঙালি পরিবার আন্দামানে শরণার্থী হিসেবে পুনর্বাসিত হয়েছিল, যা সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে এবং স্বাধীনভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। ১৯৫১ সালে যেখানে বাংলায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৩৬৩ জন, ১৯৯১ সালের মধ্যে তা ৬৪,৭০৬ জনে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাংলা ভাষা প্রধান এবং সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা।
বাঙালি উদ্বাস্তু হওয়ার প্রেক্ষাপট:
ভারত বিভাজন:
দেশভাগের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং তাদের মধ্যে অনেকেই পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে আশ্রয় নেয়।
পুনর্বাসনের উদ্যোগ:
ভারত সরকার এই শরণার্থীদের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে।
সরকারি 'উপনিবেশকরণ প্রকল্প' [sic] এর অধীনে ভারত মহাসাগরের মাঝখানে প্রায় ৪০০০ নিম্ন বর্ণের শরণার্থী পরিবারকে পাঠানোর অসম্ভব সমাধান। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জঙ্গলে আচ্ছাদিত অংশে চাষাবাদ এবং গৃহপালিত করার জন্য। ১৯৪৯ সাল থেকে, সরকারি কর্মকর্তারা আন্দামানের দরিদ্র শিবিরের বাসিন্দাদের কাছে স্থানান্তরের বিকল্পটি প্রচার করতে শুরু করেন যারা প্রায়শই গণ-দাহের অপেক্ষায় মৃতদেহ নিয়ে বাস করতেন। তালিকাভুক্ত পরিবারগুলিকে সাবধানে নির্বাচন করা হয়েছিল যাতে নিশ্চিত করা যায় যে তাদের পর্যাপ্ত সংখ্যক সুস্থ পুরুষ শ্রমিক রয়েছে: কঠোর পরিশ্রমী শ্রমিকদের হাতের প্রমাণ হিসাবে কর্মকর্তাদের দ্বারা কলাস স্পর্শ এবং এবং অনুমোদন করতে হত। ক্যাম্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার, নগদ অর্থ প্রদান বন্ধ হয়ে যাওয়ার এবং সম্ভবত দণ্ডকারণ্যের মতো অন্যান্য প্রতিকূল এবং দূরবর্তী অঞ্চলে স্থানান্তরিত হওয়ার হুমকির সাথে সাথে আন্দামানে পুনর্বাসন করা অনেকের কাছেই একমাত্র আসল বিকল্প ছিল, "যেখানে বাঘ শিশুদের ধরতে আসবে"।
আন্দামানে বাঙালির জীবনযাত্রা:
ভাষা ও সংস্কৃতি:
আন্দামানে বাংলা ভাষা প্রধান এবং বহুল প্রচলিত ভাষা।
জনসংখ্যার বৃদ্ধি:
১৯৫১ সালে যেখানে মাত্র ২৩৬৩ জন বাংলাভাষী ছিল, ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৪,৭০৬ জন।
প্রাথমিক কষ্ট এবং প্রতিকূল জীবনযাত্রার পরিবেশ সত্ত্বেও, বাঙালি বসতি স্থাপনকারীরা সময়ের সাথে সাথে একটি অজানা বন্য স্থানকে একটি পরিচিত আবাসস্থলে রূপান্তরিত করে। পূর্ববঙ্গের হাজার হাজার পরিবার দ্বীপপুঞ্জে পুনর্বাসিত হয়েছিল, উভয়ই স্বাধীন অভিবাসী এবং সরকারী প্রকল্পের সুবিধাভোগী হিসাবে; ১৯৫১ সালে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাংলাভাষী জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২৩৬৩ জন, ১৯৯১ সালের মধ্যে ভারতের আদমশুমারি অনুসারে এই সংখ্যা বেড়ে ৬৪,৭০৬ জনে দাঁড়িয়েছে। আজ দ্বীপপুঞ্জগুলিতে বসবাসকারী জটিল এবং বৈচিত্র্যময় সমাজে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়, যাদের মাতৃভাষা বাংলা। এই সংখ্যা সত্ত্বেও, আন্দামানে বাঙালিদের যাত্রা এবং জীবন বেশিরভাগই একটি অলিখিত ইতিহাস।
প্রশাসনের ভূমিকা:
অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসনে বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব কম থাকে, যদিও তারা একটি বড় অংশ।
বর্তমান পরিস্থিতি:
সংঘাতের সম্ভাবনা:
যদিও বাঙালিরা অনেক ক্ষেত্রে আন্দামানে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে, তবে জনসংখ্যাগত এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে তাদের সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
আসামের নাগরিক নিবন্ধন তালিকার (এনআরসি) বিরূপ প্রভাব পড়েছে ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে। বসবাসের বিতর্কিত বৈধতাপত্র 'ইনারলাইন পারমিট' নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বাঙালিরা। এ নিয়ে স্থানীয় অবাঙালিদের সঙ্গে বাঙালিদের সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়েছে বাঙালিবিদ্বেষ।
রাজনৈতিক সচেতনতা:
বাঙালি ফোরামের মতো সংগঠনগুলি তাদের অধিকার ও দাবি আদায়ের জন্য বিভিন্ন সময় রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)





No comments:
Post a Comment