Palah Biswas On Unique Identity No1.mpg

Unique Identity No2

Please send the LINK to your Addresslist and send me every update, event, development,documents and FEEDBACK . just mail to palashbiswaskl@gmail.com

Website templates

Zia clarifies his timing of declaration of independence

what mujib said

Jyothi Basu Is Dead

Unflinching Left firm on nuke deal

Jyoti Basu's Address on the Lok Sabha Elections 2009

Basu expresses shock over poll debacle

Jyoti Basu: The Pragmatist

Dr.BR Ambedkar

Memories of Another day

Memories of Another day
While my Parents Pulin Babu and basanti Devi were living

"The Day India Burned"--A Documentary On Partition Part-1/9

Partition

Partition of India - refugees displaced by the partition

Friday, February 15, 2013

সুখবর হল একূশে উদ্ যাপনের আগেই সুদুর দক্ষিণাত্যে কর্ণাটক রাজ্যে পুনর্বাসিত বাঙ্গালিরা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষার অধিকার দীর্ঘ চার দশকের অন্ধকার পেরিয়ে জিতেছেন।নিখিল ভারত উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতির অধ্যক্ষ এই উপলক্ষে আগামী পয়লা মার্চ নিখিল ভারত উদ্বাস্তু সমিতি ও কর্ণাটক উদ্বাস্তু সমিতির তরফ থেকে কর্ণাটক মাতৃভাষা বিজয় দিবস পালন করার ডাক দিয়েছেন।এই ডাকে সাড়া দেবেন?

সুখবর হল একূশে উদ্ যাপনের আগেই সুদুর দক্ষিণাত্যে কর্ণাটক রাজ্যে পুনর্বাসিত বাঙ্গালিরা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষার অধিকার দীর্ঘ চার দশকের অন্ধকার পেরিয়ে জিতেছেন।নিখিল ভারত উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতির অধ্যক্ষ এই উপলক্ষে আগামী পয়লা মার্চ নিখিল ভারত উদ্বাস্তু সমিতি ও কর্ণাটক উদ্বাস্তু সমিতির তরফ থেকে কর্ণাটক মাতৃভাষা বিজয় দিবস পালন করার ডাক দিয়েছেন।এই ডাকে সাড়া দেবেন?

পলাশ বিশ্বাস

বাঙালির সরস্বতী পুজো এখন 
বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্স ডেও বটে।

অন্ততঃ পশ্চিমবঙ্গে

বাংলার বাইরে দেশ ভাগের পরে যাদের ফেলে দেওয়া হল, তাঁরা সর্ব ভারতীয় মুক্ত বাজারের মধ্যে নিজের অস্তিত্বের লড়াইয়ে রক্তাক্ত হতে থাকলেও বাঙাল ভাষাতেই কথা বলতে অভ্যস্ত।তাঁরা পশ্চিম বঙ্গীয় ভদ্রলোক ভাষায় কথা বলতে পারেন না

মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার তাঁদের কোনো কোনো রাজ্যে আছে, বহু রাজ্যেই নেই

এমনকি দন্ডকারণ্য ও আন্দামানের পর সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্তুর বাস যেখানে, সেই উত্তরাখন্ড ও উত্তরপ্রদেশে মাতৃভাষার অধিকার বাঙ্গালি উদ্বাস্তুদের নেই


 যেমন তামিলনাডুতে চা বাগানে বা কফি বাগানে যাদের পুনর্বাস দেওয়া হয়েছে, রাজস্থানের মরুস্থলে যাদের বসবাস, তাঁদের মাতৃভাষা শেখার সুযোগ নেই, বলাই বাহুল্য

 সর্বক্ষেত্রে অবশ্য তাঁদের নাগরিকত্ব ভারত ভাগের পর পুনর্বাসিত হওয়ার এতদিন পর এক বাঙ্গালি সন্তান প্রণব মুখার্জির কল্যাণে সন্দিগ্দ্ধ।এই পশ্চিম বাংলাতেও

তিনি আজ একের পর এক ফাঁসিক আদেশ জারি করছেন, আমাদের গণফাঁসির ব্যবস্থা ত তিনি বহুকাল আগেই করে দিয়েছেন

ত্রিপুরাতে অবশ্য বাংলা ভাষায় শিক্ষা অধিকার আছে। কবি অনিল সরকারের মত উদ্বাস্তুরা সরকারেও আছেন।কিন্তু তাঁদের লেখা পড়ার স্বীকৃতি বাংলাদেশে থাকলেও এই বঙ্গে নেই।আসাম, বিহার ,ঝাড়খন্ডের বাঙ্গালি উদ্বাস্তুদের লেখালেখির খবরআমরা কতটা কি জানি?

 লোক অস্পৃশ্য বাঙ্গালিরা, যাদের ভারত ভাগের পর সুপরিকল্পিত ভাবে পাহাড়ে, জঙ্গলে, মরুস্থলে এবং সমুদ্রের মাঝখানে দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হল কায়েমি ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক কর্তৃত্ব স্থাপনার তাকিদে, তাঁরা আজও পূরাতন ঐতিহ্যের বন্ধনে আবদ্ধ। 

এবং তাঁরাই আসামের কাছাড়ে মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে আত্মবলিদান দিয়েছিলেন

সীমান্তের ওপারে যারা আজ একুশের চেতনায়, অহন্কারি উদ্বুদ্ধ , তাঁরা কিন্তু এই বাঙ্গালির ইতিহাস ভূগোল থেকে ফেলে দেওয়া উদ্বাস্তুদেরই ধর্মান্তরিত ভাই বান্ধবরা

পশ্চিম বাংলার ভদ্রলোকদের সঙ্গে ওপার এপার কোনো পারের  বাঙ্গালির রক্ত বা আত্মার কোনো সেতুব্ধন নেই।ইউরোপ আমেরিকায় ও সারা বিশ্বে প্রবাসী বাঙ্গালিদের সঙ্গে অতি অবশ্যই আছে

এমনিতেই বাঙ্গালির ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে পশ্চিমবঙ্গীয় ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক আধিপাত্য নির্বিবাদ, তাই মাতৃভাষার অধিকার নিয়ে তাঁদের কোনো দিনই লড়তে হয় নি

 রক্ত ঝরাতে হয়নি।এক ফোঁটাও।একুশে চেতনা এখানে অবিরাম অক্লান্ত রক্তঝরা লড়াই নয়।বাংলাদেশের একুশে চেতনা বা বাংলার বাইরে উদ্বাস্তু বাঙ্গালির চরম বিপর্যয় ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাতৃভায়ার লড়াই স্থানীয় সিপিএম তৃণমুল কংগ্রেস রাজনীতির রগরগে উত্তেজনা বা ভ্যালেন্টাইন ডে র মত আলোড়িত করে না

যেমন আশিস নন্দীর ওবিসি এসসি এসটি বিরোধী মন্তব্যের বিরুদ্ধে ত্রিশ ত্রিশ টি সংস্থার একযোগে ধিক্কার প্রতিবাদ এখানে খবর হয় না,তেমনি উদ্বাস্তুরাও খবর হয় না

বলবেন মতুয়ারাও ত উদ্বাস্তু এবং ওঁদের খবর হয়।ওঁদের খবর না হলে পরিবর্তন হয় না, প্রত্যাবর্তন অসম্ভব

মরিচঝাঁপির গণহত্যাও এি বাংলাকে আলোড়িত করেনি

বাংলার বাইরেরে বাঙ্গালিদের মাতৃভাষার লড়াইয়ে তাই আমরা পশ্চিম বঙ্গকে পাশে পাইনি কোনোদিন

তবু আমাদের লড়াই থেমে থাকে নি, থাকবে না

সুখবর হল একূশে উদ্ যাপনের আগেই সুদুর দক্ষণাত্যে কর্ণাটক রাজ্যে পুনর্বাসিত বাঙ্গালিরা অষ্টম শ্রেণী পর্য়ন্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষার অধিকার দীর্ঘ চার দশকের অন্ধকার পেরিয়ে জিতেছেন

নিখিল ভারত উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতির অধ্যক্ষ এই উপলক্ষে আগামী পয়লা মার্চ নিখিল ভারত উদ্বাস্তু সমিতি ও কর্ণাটক উদ্বাস্তু সমিতির তরফ থেকে কর্ণাটক মাতৃভাষ বিজয় দিবস পালন করার ডাক দিয়েছেন

এই ডাকে সাড়া দেবেন?


মহাবোধি সোসাইটি হলে কলেজ স্কায়ার কোলকাতায় সন্ধ্যা ছ টায় ওবিসি , আদিবাসিদের ও দলিতদের বিরুদ্ধে আশিস নন্দীর বক্তব্যের বিরুদ্ধে ধিক্কার সভা হয়ে গেল!আমরা বেশ ভালো করে জানি বাংলার অচলায়তন ভাঙ্গতে মনুস্মৃতি কর্তৃত্বকে আঘাত করতে নিজেদের অধিকারের দাবিতে বাংলায় বহুজন সমাজ গঠনের কাজ শুরু হতে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হবে৤ওপার বাংলা আবার জাগ্রত ইসলামী বাংলাদেশী জাতিয়তার বিরুদ্ধে বাঙ্গালি জাতিসত্তার লড়াইয়ে রাস্তায়  নেমেছে সারা বাংলা দেশ!অথচ এপার বাংলায় বাঙ্গালিত্ব বলতেই বোঝায় ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক আধিপাত্য!এই আধিপাত্যর দরুণ আশিসনন্দীর বক্তব্য নিয়ে, ওবিসি, উপজাতি ও তফসিলীদের ক্ষমতায়ন নিয়ে এখনই কোন বিতর্ক এই বাংলায় হবে না, যেখানে আড়াআড়ি পক্ষ বিপক্ষে বিভক্ত জনমানসে তৃতীয় পক্ষের কোনও সুযোগ নেই!যেমন সুযোগ নেই সমতা, সামাজিক ন্যায়, আইনের  শাসন ও গণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষতার!বাংলাদেশে চরম আক্রমনের মুখেও জাগ্রত বাঙ্গালি জাতি সত্তা, তাই বাংলাদেশী ইসলামী জাতীয়তার জিগির সত্ত্বেও সেখানে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশ কখনো নষ্ট হয়নি!পৃথীবীর আর কোনো দেশে সংখ্যালঘুদের নাগরিক মানবাধিকার রক্ষার লড়াইয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবিদের আত্মবলিদানের নজির নেই!অথচ বাংলায় অন্য পক্ষ, বহুজনসমাজের কোনও কথা কোথাও বলার লেখার সুযোগ নেই!মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে লক্ষ লক্ষ প্রামের বিনিময়ে ভূমিষ্ঠ হয় বাংলাদেশ!আসামের  কাছাড়েও বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে উদ্বাস্তু বাঙ্গালিরা!পশ্চিম বাংলার সেই ইতিহাস নেই!ভারতের রাষ্ট্রপতি বাঙ্গালি ব্রাহ্মণ সন্তান, হিন্দুত্ভের সর্বোচ্চ ধর্মাধিকারি, চন্ডী পাঠ দিয়ে যার দিন শুরু হয় আর রাষ্ট্রপতি ভবনকে যিনি চন্ডীমন্ডপে পরিণত করেছেন!ভারতের রাজনীতিতে পশ্চিম বাংলার কর্তৃত্ব প্রবল!কিন্তু তাঁদের কেউই বাঙ্গালি উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের দাবি তোলেন নি!উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতেই তাঁরা বরং  সর্বদলীয় সম্মতিতে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন পাশ করেছেন, চালূ করেছেন আধার যোজনা!বাংলার বাইরে বাঙ্গালিরা সংরক্ষণ থেকে বন্চিত!তাঁদের নাগরিকত্ব ওবং একমাত্র তাংদেরই নাগরিকত্ব সন্দিগ্দ্ধ!এই পশ্চিম বাংলায় সন্দিগ্দ্ধ নাগরিকত্বের অজুহাতে লাখো লাখো উদ্বাস্তুর নাম ভোটার লিস্ট থেকে কাটা হল , প্রতিবাদ হয়নি!তিন দশক ব্যাতীত দন্ডকারণ্য থেকে নির্বাচনী অঙ্কের খাতিরে ডেকে এনে বাঙ্গালি উদ্বাস্তুদের মরিচঝাঁপিতে কোতল করা হল!মায়েরা ধর্ষিতা হলেন!শিসুরা অনাথ হল!রক্তে ভিজে গেল মাটি!প্রবল ভাবে স্থানীয় রাজনীতিতে ক্ষমতার লঢ়াইয়ে আমরা ওরাঁয় দ্বিধা বিভক্ত নাগরিক সুশীল সমাজ তিন দশকেও মুখ খোলেনি!বাংলার বাইরে বাঙালিদের মাতৃভায়ার অধিকারের দাবিতে সরব হয়নি!তাঁরা মাত্র বাংলার বাইরে পাঁচ লক্ষ উদ্বাস্তু আছে, এই কথা বলে কোটি কোটি বাঙ্গালির অস্তিত্ব অস্বীকার করতেই অভ্যস্ত!একশো বছর যাদের ক্ষমতায়ন হয়নি, হুর্নীতি প্রসঙ্গে তাংদের কথা বলে বড় মুশকিলে ফেলে দিয়েছেন শাসক শ্রেনীকে সমাজবিজ্ঞানী আশিসনন্দী, তাই ঘটা করে জানিয়ে দিতে হল তিনি জাতে তেলী, নবশাঁখ! অর্থাত তাঁর কথাকে, তাঁর দেওয়া তথ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হবে না!আজও রক্তে ভেসে যাচ্ছে জমিন!আজও লজ্জিত মানুষ!আজও ধর্ষিতা মায়েরা!কিন্তু এই বাংলায় কোনো লজ্জা লেখা হবে না! রোজ টিভি দেখতে ভয় হয়, আবার কোথায় রক্তপাত হল !আবার আাদেরই কে মারা পড়ল! কোন মেয়েটি াবার ধর্ষিতা হল!

আজও রক্তে ভেসে যাচ্ছে জমিন!আজও লজ্জিত মানুষ!আজও ধর্ষিতা মায়েরা!কিন্তু এই বাংলায় কোনো লজ্জা লেখা হবে না! রোজ টিভি দেখতে ভয় হয়, আবার কোথায় রক্তপাত হল !আবার আমাদেরই কে মারা পড়ল! কোন মেয়েটি আবার ধর্ষিতা হল!

যুদ্ধ অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগ এখন প্রতিবাদ 

মুখর। হাজার হাজার তারুণ্যের প্রতিবাদ মুখর স্লোগানে 


উত্তপ্ত ঢাকার শাহবাগ চত্বর। সবার কেবল একটাই দাবী 


যুদ্ধ অপরাধীদের ফাঁসিচাই। জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে 


চাই। পশ্চিম বাংলা ও বারতবর্ষের যুদ্ধ অপরাধীদের 


বিরুদ্ধে আমরা কবে রাস্তায় নামতে পারব?

"সারাদেশে একাত্তরের চেতনার উত্তাল ঢেউ জেগেছে। জেগে উঠেছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। তাকে স্বাগত জানাই। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নতুন প্রজন্ম জাতিকে আশাবাদী করেছে। যে কোনো মূল্যে এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।"

গত পাঁচই ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধে জামাতের নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় আদালত। এই রায় প্রত্যাখান করে আন্দোলনে নামে বাংলাদেশের যুব সমাজ। অন্যদিকে মঙ্গলবার ঢাকার রাজপথে মিছিল করে জামাতে ইসলামি। ট্রাইবুনাল ভেঙে দেওয়া ও আব্দুল কাদের মোল্লাসহ দোষীসাব্যস্ত নেতাদের মুক্তির দাবি জানায় তারা। এর পরেই পুলিসের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায়। অশান্ত হয়ে ওঠে মতিঝিল, করওয়ান বাজার এলাকা। 


তথাকথিত সুশীল সমাজের কুশীলবদের রক্ত কি হাড়হিম হয়ে গেল নাকি! উচ্ছিষ্ট ভোগী বুদ্ধিজীবীরা কোন থালায় কি চাটছেন এখন? 
কালীঘাটের ক্যানভাসে ছবি আঁকার জন্য কতটা চুন আর কালি আছে যা বিক্রি করে শ্মশানের ল্যাম্পোস্টে রবীন্দ্রসংগীত বাজানো হবে? 
দিদি প্রকাশ্যে পুলিশ কর্মীদের চাবকানোর হুমকি দিচ্ছেন। ভাইয়েরা পুলিশ খুন করে আনুগত্য দেখাচ্ছে। 
আর কত মায়ের কোল খালি হবে? কতটা রক্তে পিছল হবে মাটি? বাংলার মানুষ আর কতটা লজ্জিত হবে?
একমাত্র তিনিই জানেন এর উত্তর। আমরা উত্তরটা তার কাছ থেকে পেতে চাই।

যুদ্ধ অপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে স্লোগান দিচ্ছে দুই শিশু
যুদ্ধ অপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে স্লোগান দিচ্ছে দুই শিশু

Monday, February 11, 2013

আশিস নন্দী মহাশয়কে একটি খোলা চিঠি

আশিস নন্দী মহাশয়কে একটি খোলা চিঠি
আপনাকে ধন্যবাদ আশিস নন্দী মহাশয়। ধন্যবাদ এই কারণে যে আপনি শাসক শ্রেণীর পক্ষ নিয়েও পশ্চিমবঙ্গের আর্থ সামাজিক বিকাশের প্রকৃত সত্যটি উন্মোচন করে দিয়েছেন। জয়পুর করপোরেট সাহিত্য উত্সবে "সংরক্ষন বিরোধী মঞ্চে" আপনি বলেছেন যে, ভারতবর্ষে দুর্নীতির জন্য দায়ী হল এসসি, এস টি ও ওবিসি মানুষেরা । ... গত একশো বছরে এসসি/এসটি ও ওবিসিরা পশ্চিমবঙ্গে শাসন ক্ষমতায় নেই তাই এখানে দুর্নীতি কম। অর্থাৎ আপনি পরিষ্কার করে উল্লেখ করেছেন যে,গত একশো বছর ধরে পশ্চিম বাংলায় এসসি/এসটি ও ওবিসিদের কোন আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়নি। ক্ষমতায়ন হয়েছে এই ৩ ক্যাটেগোরির বাইরের মানুষদের। আপনাকে আরো ধন্যবাদ জানানো যেত যদি আপনি এই তালিকার সাথে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরও জুড়ে দিতেন। তবেই বাংলার বহুজনকে চিহ্নিত করতে আমাদের সুবিধা হত। 

আপনার আলোচনা সূত্র ধরে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন এসে যায় যে, এই ৩ ক্যাটেগোরির বহুজন সমাজের বাইরের মানুষ কারা? এবং বাংলার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তাদের পরিচয় কি? বা অবস্থান কোথায়?
সেন্সাস, ২০০১ অনুশারে পশ্চিমবঙ্গে এসসি/এসটি ও ওবিসিদের জনসংখ্যাগত অবস্থান নিম্নরূপঃ
এসসি - মোট জনসংখ্যার- ২৩%
এসটি- মোট জনসংখ্যার- ৫.৫%
ওবিসি- মোট জনসংখ্যার- ৬০ % এর বেশী। 
ব্রাহ্মণ - মোট জনসংখ্যার- ২ %
কায়স্থ/বদ্দি -মোট জনসংখ্যার- ৩%
অন্যান্য- মোট জনসংখ্যার- ৬.৫%
এখানে অন্যান্য জনসংখ্যার মধ্যে আছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং অবাঙ্গালী মানুষেরা। যাদের অধিকাংশই আপনার উল্লেখিত শাসক শ্রেনীর মানুষ নয়। অর্থাৎ নির্দ্বিধায় একথা বলা যায় যে,পশ্চিমবঙ্গের ৯৫% মূলনিবাসী বহুজন বাঙালীর ১০০ বছরের মধ্যে কোন ক্ষমতায়ণ হয়নি। ক্ষমতায়ণ হয়েছে মাত্র ৫% মানুষের, যারা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে অবঙ্গীয়। হয় তারা আনিত,নতুবা অনুপ্রবেশকারী অথবা বহিরাগত। তাই আপনার কথিত ১০০ বছর নয়, বরং পাল যুগ অবসানের পরবর্তী কাল থেকে বাংলার মূলনিবাসী বহুজন কতিপয় অবাঙ্গালী শোষকদের কাছে পদানত,শৃঙ্খলিত অপমানিত।

এখন প্রশ্ন হল, আপনি কোন মাপক শলাকায় জরিপ করে দাবী করলেন যে,বাংলায় অবঙ্গীয় শাসকদের সুশাসনে দুর্নীতি কম। এবং এই অবঙ্গীয়দের সুশাসনে বাংলার মূলনিবাসীরা দুধে-ভাতে প্রতিপালিত হচ্ছে। তাদের সন্তানেরা অপুষ্টি নিয়ে জন্মাচ্ছে না। মহিলারা অ্যানিমিয়াতে ভুগছে না। তাদের সন্তানেরা সুশিক্ষিত উঠছে। এবং অধিকাধিক সুযোগ পেয়ে বাংলাকে শ্মশান থেকে তুলে এনে সোনার বাংলায় রূপায়িত করে ফেলেছে।
আপনি কি বোঝাতে চাইছেন যে, অবঙ্গীয় শাসকেরা যেহেতু মূলনিবাসীদের কাঙ্খিত ক্ষমতায়ানের সব কলস ভর্তি করে দিচ্ছে তাই মূলনিবাসীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ানের কোন প্রয়োজন নেই। তেলা মাথায় বেশী করে তেল ঢাললে সে তেল গড়িয়ে গড়িয়ে পায়ের তলার ধুলোকেও ভিজিয়ে দেবে। এতেই অনায়াশে ভর্তি হয়ে যাবে প্রান্তজনের পেট। কি দরকার এত কিছু বুঝে? কি দরকার এত মাথাব্যাথার। বরং তারা সুশাসনের সুবাতাস নিয়ে মিলেনিয়াম, বিলেনিয়াম, সান সিটি বা ফ্যান সিটিতে ঘুরে বেড়াক। জল-জঙ্গল -জমি বেঁচে দিক। চাষবাসের মত আদিম বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে ন্যানো,ফিয়াট বা স্কর্পিওর চাকায় হাওয়া দিক।
রাস্তার পাশে দোকান খুলে বসুক। পিঁয়াজি, ফুলুরি মায় চাউমিন বিক্রি করুক । গ্রামের মেয়েগুলো ঘুঁটে গোবরের আল্পনা ছেড়ে বিউটিপার্লার আর ম্যাসাজ সেন্টারে গিয়ে ট্রেনিং নিক। রাতের বেলা ব্রথেল গুলোতে অতিথিদের আপ্যায়ন করতে শিখুক। উন্নয়নের এটাইতো গতিমুখ। সেটাই যখন তড়িৎ গতিতে তরান্বিত হচ্ছে, তখন মুলনিবাসীদের আলাদা সংরক্ষণ আলাদা করে ক্ষমতায়ানের কোন দরকার নেই! 

ধন্য আপনি আশিস নন্দী মহাশয়। ব্রাহ্মন্যবাদীদের সাথে জলচলের সহবস্থানে আপনার এ অমোঘ পরিণতিতে আমরা বিস্মিত নই। বরং এটাই কঙ্খিত। কেননা প্রসাদান্ন ভোগ করা ভৃত্যের কাছে প্রভুর মাহাত্ব কীর্তন নতুন কিছু নয়। দাসত্বের এ এক পুরাতনী বিধান। যেটা আপনি স্বভক্তি তা পালন করেছেন। আপনার মঙ্গল ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি। 

আমি জানিনা আপনার সমাজতত্ত্বের বিনম্র অধ্যায়নে ইতিহাসের কতটা মূল্য আছে। শোষণ শাসনের কোন নীতি শ্রম এবং উৎপাদক শ্রেণির কাছ থেকে তাদের জীবন-জীবিকা,আত্মপরিচয়,মান-মর্যাদা কেড়ে নিয়ে তাদের অপাঙ্কতেয়,অশুচি করে দেয় তা আপনার আভিধানিক শব্দ সঞ্চয়নের মধ্যে আছে কিনা।

আপনি হয়তো জেনে থাকবেন যে ১৯০৬ সালে মহাত্মা গুরুচাঁদের নেতৃত্বে বাংলা এবং আসামের লেপ্টেন্যান্ট ল্যান্সল টের কাছে একটি তালিকা দিয়ে বাংলার দলিত জাতিসমূহের জন্য ভাগিদারী দাবী করা হয়। সেই তালিকায় বাংলার চন্ডাল সহ যে ৩১ টি জাতির নাম দেওয়া হয়েছিল সেখানে আপনার জাতি তিলি-নবশাখ তালিকা ভুক্ত ছিল। ১৯০৭ সালে আসাম বাংলার জন্য এই আইন কার্যকরী হয়। নেটিভরা শিক্ষা, চাকরী ও রাজকার্যে ভাগিদারী পায়। ১৯০৯ সালের মর্লি মিন্টো সংস্কার আইনে গুরচাঁদের দেখানো এই পথ সারা ভারতবর্ষের জন্য স্বীকার করে নেওয়া হয় এবং ১৯১৯ সালের মন্টেগু চেমস ফোরডের ভারত শাসন আইনে সমগ্র ভারতের জন্য তা কার্যকরী হয়। অর্থাৎ আপনার পূর্ব পুরুষদের শিক্ষা সম্ভব হয়েছিল সংরক্ষণ আইনের জন্যই। আর আপনার এপর্যন্ত অর্জিত সমস্ত সুখ্যাতির প্রতিটি পালকের গোড়া ছিল সংরক্ষিত। কিন্তু,আপনি এখন সংরক্ষণ বিরোধী মঞ্চের প্রধান প্রবক্তা।
বেশ বেশ!
সমগ্র মূলনিবাসীরা আপনাকে দেখে নিয়েছে! যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। যা করবার করেছে। কিন্তু আমরা এখনো অনেক উত্তর আপনার কাছ থেকে পাইনি।

আপনি কি আমাদের বুঝিয়ে বলবেন,কোন সুশাসনের কল্যাণে মূলনিবাসীদের সমস্ত সম্পদ, স্থাবর-অস্থাবর,জল-জঙ্গল-জমি মুষ্টিমেয় অবঙ্গীয় শাসকদের হাতে পুঞ্জিভুত হয়? শ্রম এবং উৎপাদক শ্রেণীর পেটের উপর পা দিয়ে পরগাছা, পরভোগীদের স্বেচ্ছাচারের ইমারৎ ওঠে। এবং এই প্রক্রিয়াকে সুশাসন বলে মহিমান্বিত করার জন্য আপনার মত একজন জলচল শূদ্রকে ময়দানে নামানো হয়। সময় পেলে বলবেন। অন্য কোথাও। অন্যখানে। আমরা মূলনিবাসী বঙ্গবাসী এসসি/এস টি,ওবিসি সমাজ আপনাকে গৌড়ীয় সুধা পান করতে দেখে ধন্য হব।
ধন্যবাদান্তে
শরদিন্দু উদ্দীপন
সোনারপুর, কোলকাতা-৭০০১৫০
আশিস নন্দী মহাশয়কে একটি খোলা চিঠি  আপনাকে ধন্যবাদ আশিস নন্দী মহাশয়। ধন্যবাদ এই কারণে যে আপনি শাসক শ্রেণীর পক্ষ নিয়েও পশ্চিমবঙ্গের আর্থ সামাজিক বিকাশের প্রকৃত সত্যটি উন্মোচন করে দিয়েছেন। জয়পুর করপোরেট সাহিত্য উত্সবে "সংরক্ষন বিরোধী মঞ্চে" আপনি বলেছেন যে, ভারতবর্ষে দুর্নীতির জন্য দায়ী হল এসসি, এস টি ও ওবিসি মানুষেরা । ... গত একশো  বছরে এসসি/এসটি ও ওবিসিরা পশ্চিমবঙ্গে শাসন ক্ষমতায় নেই তাই এখানে দুর্নীতি কম। অর্থাৎ আপনি পরিষ্কার করে উল্লেখ করেছেন যে,গত একশো বছর ধরে পশ্চিম বাংলায় এসসি/এসটি ও ওবিসিদের কোন আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়নি। ক্ষমতায়ন হয়েছে এই ৩ ক্যাটেগোরির বাইরের মানুষদের। আপনাকে আরো ধন্যবাদ জানানো যেত যদি আপনি এই তালিকার সাথে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরও জুড়ে দিতেন। তবেই বাংলার বহুজনকে চিহ্নিত করতে আমাদের সুবিধা হত।      আপনার আলোচনা সূত্র ধরে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন এসে যায় যে, এই ৩ ক্যাটেগোরির বহুজন সমাজের বাইরের মানুষ কারা? এবং বাংলার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তাদের পরিচয় কি? বা অবস্থান কোথায়?  সেন্সাস, ২০০১ অনুশারে পশ্চিমবঙ্গে এসসি/এসটি ও ওবিসিদের জনসংখ্যাগত অবস্থান নিম্নরূপঃ  এসসি - মোট জনসংখ্যার- ২৩%  এসটি- মোট জনসংখ্যার- ৫.৫%  ওবিসি- মোট জনসংখ্যার- ৬০ % এর বেশী।            ব্রাহ্মণ - মোট জনসংখ্যার- ২ %  কায়স্থ/বদ্দি -মোট জনসংখ্যার- ৩%  অন্যান্য- মোট জনসংখ্যার- ৬.৫%  এখানে অন্যান্য জনসংখ্যার মধ্যে আছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং অবাঙ্গালী মানুষেরা। যাদের অধিকাংশই আপনার উল্লেখিত শাসক শ্রেনীর মানুষ নয়। অর্থাৎ নির্দ্বিধায় একথা বলা যায় যে,পশ্চিমবঙ্গের ৯৫% মূলনিবাসী বহুজন বাঙালীর ১০০ বছরের মধ্যে কোন ক্ষমতায়ণ হয়নি। ক্ষমতায়ণ হয়েছে মাত্র ৫% মানুষের, যারা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে অবঙ্গীয়।  হয়  তারা আনিত,নতুবা অনুপ্রবেশকারী অথবা বহিরাগত। তাই আপনার কথিত ১০০ বছর নয়, বরং পাল যুগ অবসানের পরবর্তী কাল থেকে বাংলার মূলনিবাসী বহুজন কতিপয় অবাঙ্গালী শোষকদের কাছে পদানত,শৃঙ্খলিত অপমানিত।    এখন প্রশ্ন হল, আপনি কোন মাপক শলাকায় জরিপ করে দাবী করলেন যে,বাংলায় অবঙ্গীয় শাসকদের সুশাসনে দুর্নীতি কম। এবং এই অবঙ্গীয়দের সুশাসনে বাংলার মূলনিবাসীরা দুধে-ভাতে প্রতিপালিত হচ্ছে। তাদের সন্তানেরা অপুষ্টি নিয়ে জন্মাচ্ছে না। মহিলারা অ্যানিমিয়াতে ভুগছে না। তাদের সন্তানেরা সুশিক্ষিত  উঠছে। এবং অধিকাধিক সুযোগ পেয়ে বাংলাকে শ্মশান থেকে তুলে এনে সোনার বাংলায় রূপায়িত করে ফেলেছে।  আপনি কি বোঝাতে চাইছেন যে, অবঙ্গীয় শাসকেরা যেহেতু মূলনিবাসীদের কাঙ্খিত ক্ষমতায়ানের সব কলস ভর্তি করে দিচ্ছে তাই মূলনিবাসীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ানের কোন প্রয়োজন নেই। তেলা মাথায় বেশী করে তেল ঢাললে সে তেল গড়িয়ে গড়িয়ে পায়ের তলার ধুলোকেও ভিজিয়ে দেবে। এতেই অনায়াশে ভর্তি হয়ে যাবে প্রান্তজনের পেট। কি দরকার এত কিছু বুঝে? কি দরকার এত মাথাব্যাথার। বরং তারা সুশাসনের সুবাতাস নিয়ে মিলেনিয়াম, বিলেনিয়াম, সান সিটি বা ফ্যান সিটিতে ঘুরে বেড়াক। জল-জঙ্গল -জমি বেঁচে দিক। চাষবাসের মত আদিম বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে ন্যানো,ফিয়াট বা স্কর্পিওর চাকায় হাওয়া দিক।  রাস্তার পাশে দোকান খুলে বসুক। পিঁয়াজি, ফুলুরি মায় চাউমিন বিক্রি করুক । গ্রামের মেয়েগুলো ঘুঁটে গোবরের আল্পনা ছেড়ে বিউটিপার্লার আর ম্যাসাজ সেন্টারে গিয়ে ট্রেনিং নিক। রাতের বেলা ব্রথেল গুলোতে অতিথিদের আপ্যায়ন করতে শিখুক। উন্নয়নের এটাইতো গতিমুখ। সেটাই যখন তড়িৎ গতিতে তরান্বিত হচ্ছে, তখন মুলনিবাসীদের আলাদা সংরক্ষণ আলাদা করে ক্ষমতায়ানের কোন দরকার নেই!      ধন্য আপনি আশিস নন্দী মহাশয়। ব্রাহ্মন্যবাদীদের সাথে জলচলের সহবস্থানে আপনার এ অমোঘ পরিণতিতে আমরা বিস্মিত নই। বরং এটাই কঙ্খিত। কেননা প্রসাদান্ন ভোগ করা ভৃত্যের কাছে প্রভুর মাহাত্ব কীর্তন নতুন কিছু নয়। দাসত্বের এ এক পুরাতনী বিধান। যেটা আপনি স্বভক্তি তা পালন করেছেন। আপনার মঙ্গল ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।        আমি জানিনা আপনার সমাজতত্ত্বের বিনম্র অধ্যায়নে ইতিহাসের কতটা মূল্য আছে। শোষণ শাসনের কোন নীতি শ্রম এবং উৎপাদক শ্রেণির কাছ থেকে তাদের জীবন-জীবিকা,আত্মপরিচয়,মান-মর্যাদা কেড়ে নিয়ে তাদের অপাঙ্কতেয়,অশুচি করে দেয় তা আপনার আভিধানিক শব্দ সঞ্চয়নের মধ্যে আছে কিনা।    আপনি হয়তো জেনে থাকবেন যে ১৯০৬ সালে মহাত্মা গুরুচাঁদের নেতৃত্বে  বাংলা এবং আসামের লেপ্টেন্যান্ট ল্যান্সল টের কাছে একটি তালিকা দিয়ে বাংলার দলিত জাতিসমূহের জন্য ভাগিদারী দাবী করা হয়। সেই তালিকায় বাংলার চন্ডাল সহ যে ৩১ টি জাতির নাম দেওয়া হয়েছিল সেখানে আপনার জাতি তিলি-নবশাখ তালিকা ভুক্ত ছিল। ১৯০৭ সালে আসাম বাংলার জন্য এই আইন কার্যকরী হয়। নেটিভরা শিক্ষা, চাকরী ও রাজকার্যে ভাগিদারী পায়। ১৯০৯ সালের মর্লি মিন্টো সংস্কার আইনে গুরচাঁদের দেখানো এই পথ সারা ভারতবর্ষের জন্য স্বীকার করে নেওয়া হয় এবং ১৯১৯ সালের মন্টেগু চেমস ফোরডের ভারত শাসন আইনে সমগ্র ভারতের জন্য তা কার্যকরী হয়। অর্থাৎ আপনার পূর্ব পুরুষদের শিক্ষা সম্ভব হয়েছিল সংরক্ষণ আইনের জন্যই। আর আপনার এপর্যন্ত  অর্জিত সমস্ত সুখ্যাতির প্রতিটি পালকের গোড়া ছিল সংরক্ষিত। কিন্তু,আপনি এখন সংরক্ষণ বিরোধী মঞ্চের প্রধান প্রবক্তা।  বেশ বেশ!  সমগ্র মূলনিবাসীরা আপনাকে দেখে নিয়েছে! যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। যা করবার করেছে। কিন্তু আমরা এখনো অনেক উত্তর আপনার কাছ থেকে পাইনি।    আপনি কি আমাদের বুঝিয়ে বলবেন,কোন সুশাসনের কল্যাণে মূলনিবাসীদের সমস্ত সম্পদ, স্থাবর-অস্থাবর,জল-জঙ্গল-জমি মুষ্টিমেয় অবঙ্গীয় শাসকদের হাতে পুঞ্জিভুত হয়? শ্রম এবং উৎপাদক শ্রেণীর পেটের উপর পা দিয়ে পরগাছা, পরভোগীদের  স্বেচ্ছাচারের ইমারৎ ওঠে। এবং এই প্রক্রিয়াকে সুশাসন বলে মহিমান্বিত করার জন্য আপনার মত একজন জলচল শূদ্রকে ময়দানে নামানো হয়। সময় পেলে বলবেন। অন্য কোথাও। অন্যখানে। আমরা মূলনিবাসী বঙ্গবাসী এসসি/এস টি,ওবিসি সমাজ  আপনাকে গৌড়ীয় সুধা পান করতে দেখে ধন্য হব।  ধন্যবাদান্তে  শরদিন্দু উদ্দীপন  সোনারপুর, কোলকাতা-৭০০১৫০

বাপি কর্মকার, কলকাতা, ২২ ফেব্রুয়ারি

গত ২১ ফেব্রুয়ারি 'অক্ষয় লাইব্রেরি'র উদ্যোগে দক্ষিণ কলকাতার হরিদেবপুরের বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাব সংলগ্ন জমিতে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ জুড়ে জোর করে ঊর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে জন আন্দোলন এবং ১৯৬১ সালের ১৯ মে আসামের কাছাড়ে বাংলা ভাষার পক্ষে মানুষের আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা হয় প্রদর্শিত মাতৃভাষা কালপঞ্জিতে। সঙ্গে ছিল ছাত্রছাত্রীদের আঁকা মাতৃভাষার পক্ষে বিভিন্ন ছবি। এইসব আন্দোলনের ওপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতনে শহীদদের স্মরণ করা হয়।  
 ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয় ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে বাংলায় পরীক্ষা দেওয়া যাবে না, এই তুঘলকি ফরমানের উল্লেখ করে এবং তার বিরোধিতা করে পোস্টারও ছিল এই প্রদর্শনীতে। ছাত্রছাত্রীরা ছাড়াও অক্ষয় লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত কিছু চাকুরিজীবীও এই প্রদর্শনীতে অংশ নেয়।


তিরিশ লাখের কণ্ঠভেদী আওয়াজ শুনে যা

সূত্র:ভাষার জন্য শহীদ হওয়া যায়, এই আলোকিত মৃত্যুর অহংকারও ঐশ্বর্যের ভাষার জন্য প্রাণ দিতে শেখায়। বায়ান্নর বাংলাদেশ ভাষা-দমনে পীড়িত ও ক্ষুব্ধ সবাইকে উজ্জীবিত করেছে। বাংলাদেশের কাছের প্রতিবেশী ভারতের আসাম রাজ্যের বাঙালিরাও বাংলা ভাষার জন্য অকাতরে জীবন দিয়েছেন, একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-এর মতোই তাঁদের রক্তে সিক্ত হয়েছে ১৯ মে ১৯৬১।

শুরুতেই দ্বৈত ট্র্যাজেডির শিকার শিলচর। অবিভক্ত বাংলায় শিলচর সিলেট জেলারই অংশ ছিল। একসময় বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তা আসামের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়। অস্থিতিশীলতার শুরু তখন থেকেই। তারপর আবার সাতচল্লিশের বিভাজনের সময় চারটি মহকুমাকে সুরমা ভ্যালি থেকে বিচ্ছিন্ন করে আবার পূর্ব বাংলায় অঙ্গীভূত করা হয়। রয়ে যাওয়া খণ্ডিত অংশের অস্থিতিশীলতা আরও বেড়ে যায়। বাঙালিরা সেখানে নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে পড়ে।

সেদিন মধ্যাহ্নে রাজ্যটির কাছাড় জেলার শিলচরে ক্ষুব্ধ ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও সেনাবাহিনী গুলি চালায়; মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েন ১১ জন ভাষাসৈনিক—শচীন্দ্র পাল, হীতেশ বিশ্বাস, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দেব, সত্যেন্দ্র দেব, কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, বীরেন্দ্র সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, সুনীল সরকার এবং একজন তরুণী—কমলা ভট্টাচার্য।

তাঁদের মিছিলের কথা ছিল—জান দেব, জবান দেব না। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গানের মতোই শহীদ ১১ ভাইবোনকে নিয়ে হূদয়ছোঁয়া কবিতা রচনা করেছেন শক্তিপদ ব্রহ্মচারী:
দশটি ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন
কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল 'এই যে ঈশান কোণ—
কোন ভাষাতে হাসে-কাঁদে কান পেতে তা শোন'
শুনলি না? তো এবার এসে কুচক্রীদের ছা—
তিরিশ লাখের কণ্ঠভেদী আওয়াজ শুনে যা—
'বাংলা আমার মাতৃভাষা, ঈশান বাংলা মা।'

(চন্দ্রিমা দত্তের 'আসামে বাংলা ভাষা সংগ্রামের ৫০ বছর' থেকে উদ্ধৃত)

শুরুতেই দ্বৈত ট্র্যাজেডির শিকার শিলচর। অবিভক্ত বাংলায় শিলচর সিলেট জেলারই অংশ ছিল। একসময় বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তা আসামের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়। অস্থিতিশীলতার শুরু তখন থেকেই। তারপর আবার সাতচল্লিশের বিভাজনের সময় চারটি মহকুমাকে সুরমা ভ্যালি থেকে বিচ্ছিন্ন করে আবার পূর্ব বাংলায় অঙ্গীভূত করা হয়। রয়ে যাওয়া খণ্ডিত অংশের অস্থিতিশীলতা আরও বেড়ে যায়। বাঙালিরা সেখানে নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে পড়ে। কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলা নিয়ে গঠিত হয় বরাক ভ্যালি। সাতচল্লিশের খেয়ালি ভাঙাগড়া অসমিয়া জাতীয়তাকে উসকে দেয়; রব ওঠে—আসাম কেবল আসামিদের। তখন বাঙালি তাড়ানোর সহিংস আন্দোলনও প্রশ্রয় পেয়ে যায়।

একসময় অসমিয়া রাজ্যের স্বীকৃত ভাষা হিসেবে রাজ্যভাষা নাম পেয়ে যায় আসামিজ, বাংলা হয়ে পড়ে উপেক্ষিত জনের ভাষা। ক্রমে আসামের রাজ্যসীমায় জন্মগ্রহণকারী ও বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষী সবাই নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করে। তাদের ওপর শারীরিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো হতে থাকে। স্বাধীনতা-উত্তর আদমশুমারিতে বাঙালির সংখ্যার অবিশ্বাস্য হ্রাস ও অসমিয়ার সংখ্যার অবিশ্বাস্য বৃদ্ধি দেখিয়ে বাংলা ভাষাভাষীদের আরও প্রান্তবর্তী জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়। সমঝোতা হয়নি। ১৯৪৮ সালে এই দুই জবানের মানুষের মধ্যে দাঙ্গা হয়। পূর্ব বাংলার বাঙালিরা যেমন উর্দুকে, আসামের বাঙালিরাও তেমন অসমিয়া ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করে।

১৯৬০ সালে বাংলাকে রাজ্যভাষা করার আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। তবে আন্দোলনকারীদের স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেওয়া হয়, অসমিয়াই একমাত্র রাজ্যভাষা, বাংলার স্বীকৃত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাধ্যতামূলক অসমিয়া শিক্ষার ফরমান জারি হওয়ার পর মরিয়া হয়ে ওঠে বাঙালিরা। শিলচরের গান্ধীবাগে ১৯৬০-এর ২-৩ জুলাই দুই দিনের 'নিখিল আসাম বাংলা সম্মেলন' আহ্বান করা হয়। এর মধ্য দিয়ে অভূতপূর্ব একটি গণজাগরণ তৈরি হয়। তখন ভারতের অন্যান্য স্থানে হিন্দি-বিরোধী অসন্তোষ ও আন্দোলন দানা বাঁধছে। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন শুরু হয় ভয়াবহ দাঙ্গা। এই প্রেক্ষাপটেই অসমিয়াকে পাকাপাকিভাবে রাজ্যভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তোলা বিল ২৪ অক্টোবর পাস হয়।

আসামের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বাঙালিরা তারপর মরণকামড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন এবং অন্যদিকে সহিংস প্রতিরোধ। '৬১ সালের ১৯ মে ডাকা হয় হরতাল। প্রতিরোধে নামে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। তাদের গুলিতে শিলচর রেলস্টেশনে লুটিয়ে পড়েন ১১ জন ভাষাসংগ্রামী।

১৯৬৬ সালে বাংলা সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়—বরাক ভ্যালির কাছাড়ে অসমিয়া ও বাংলা এখন সমমর্যাদায়। ১৯৮৬ সালে আবার উচ্চশিক্ষার ভাষা হিসেবে কেবল অসমিয়াকে প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেওয়া হলে নতুন আন্দোলন শুরু হয়।
বাঙালিরা চেয়েছে শিলচর স্টেশনের নাম হোক 'ভাষাশহীদ রেলওয়ে স্টেশন'। কিন্তু রেলওয়ে যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের, রাজ্য সরকারের নয়; নতুন নামকরণে বাধা আসারই কথা।
ভাষার জন্য একসঙ্গে ১১টি মৃত্যুর নজির আর নেই।

http://www.bdtodaynews.com/%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%B6-%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%96%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%A0%E0%A6%AD%E0%A7%87%E0%A6%A6%E0%A7%80-%E0%A6%86%E0%A6%93%E0%A7%9F/

বরাক উপত্যকার বাঙালি ভাষাশহীদদেরও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি

আসামের বাঙালিরা মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতর রাজ্যভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, শহীদ হয়েছেন — আমরা অনেকেই তাঁদের আত্মাহুতির কথা মনে রাখি না। বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও ভাষাশহীদদের পরিচিতি তুলে ধরার জন্য দুটি লেখা এখানে সংকলন করা হলো। অধ্যাপক মাহবুবুল হক ও প্রয়াত সাংবাদিক মুহম্মদ ইদ্রিসের এ প্রবন্ধ দুটি ছাপা হয়েছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শাখা কর্তৃক প্রকাশিত সংকলন মাতৃভাষা-য়। সংকলনটির প্রকাশকাল : ১৮ বৈশাখ ১৪০৯, ১ মে ২০০২; সম্পাদক : আমীর রিদয়; সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন ডা. শুভার্থী কর। শুভার্থী নিজে বরাক উপত্যকা থেকে ঘুরে এসেছিলেন; তাঁর উদ্যোগেই বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ও একষট্টির উনিশে মে-র দুই স্বতন্ত্র ভাষা আন্দোলনকে একই সঙ্গে যথাযোগ্য মর্যাদায় উপস্থাপন করে প্রকাশিত হয়েছিল মাতৃভাষা নামের সংকলনটি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তথ্যসমৃদ্ধ স্বতন্ত্র গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে।
. . .

ভাষার লড়াই : বরাক উপত্যকায়
মাহবুবুল হক

১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলায় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল সে আন্দোলনের কথা বাংলাদেশের জনগণের মনে চির জাগরূক হয়ে আছে। পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের নয় বছর পরে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য এমন আর একটি আন্দোলন হয়েছিল আসামের বরাক উপত্যকায়, সে কথা আমরা অনেকেই হয়তো জানি না। কিন্তু সে আন্দোলনে রক্ত ঝরেছিল। বাঙালির আত্মপরিচয় ও অধিকার রক্ষার সংগ্রামে সেখানেও শহীদ হয়েছিল এগারোটি তাজা প্রাণ।

পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন এবং বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের মধ্যে একাধিক ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় অভিন্নতা। প্রথমত, দুটি আন্দোলনই সংগঠিত হয়েছিল বাংলা ভাষার উপর অন্য ভাষার ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়ত, দুটি আন্দোলনেই দলমত-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে দুই ভূখণ্ডের বাঙালি জনগোষ্ঠী প্রতিবাদী সংগ্রামে অংশ নিয়ে আত্মদান করেছিল অধিকার আদায় করতে গিয়ে। অন্যদিকে এ দুই আন্দোলনের মধ্যে আলাদা বিশিষ্টতাও ছিল। পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষীর (৫৬%) উপর পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া সংখ্যালঘিষ্ঠ (৭%) ভাষা উর্দুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে আসামের বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠ বাঙালির ভাষা অধিকার খর্ব করে তাদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠের অসমিয়াকে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে।

বরাক উপত্যকায় বসবাসরত বাঙালির যে ভাষা আন্দোলন তা আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের মতোই তা দানা বাঁধতে শুরু করেছিল দেশবিভাগের সময় থেকে। অবশ্য সে প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্নতর।

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষকে দ্বিধাবিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করার সময়ে শ্রীহট্টের অঙ্গচ্ছেদ ঘটিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত সিলেট জেলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। তখন প্রায় তিন লক্ষ চা-বাগান শ্রমিক — যাদের অধিকাংশই হিন্দু — আসামে আশ্রয় নেয়। অনেক অবস্থাপন্ন হিন্দু পরিবার সিলেট ছেড়ে আসামে উদ্বাস্তু হয়। এই সব বাঙালি আসামে হয়ে পড়ে সংখ্যালঘু। স্বাধীন ভারতে বহু জাতি ও বহু ভাষাগোষ্ঠী অধ্যুষিত আসাম রাজ্যে বাঙালিকে বিদেশী এবং বহিরাগত রূপে চিহ্নিত করার হীন অপপ্রয়াস শুরু হয়। আসামের প্রতি বাঙালিদের আনুগত্য নিয়ে সংশয়, সন্দেহ ও প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে মহল বিশেষের উদ্যোগে প্ররোচনায়। এমনকি, অসমিয়া ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিকে অন্তরায় হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে। 'আসাম শুধু অসমিয়াদের জন্য' এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে সেখানে বাঙালির অধিকার হরণের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চলতে থাকে। শুরু হয় বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলিকে সুপরিকল্পিতভাবে অসমিয়াকরণের প্রয়াস। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং অন্যথায় তাদের অনুদান বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ফলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১-র মধ্যে সেখানে ২৫০টি বাংলা মাধ্যমের স্কুলের মধ্যে ২৪৭টিই বন্ধ হয়ে যায়। এককথায় ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে ভাষা, শিক্ষা, নিয়োগ, এমনকি ভূমি বণ্টন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আসাম সরকারের নীতি-অবস্থান হয়ে দাঁড়ায় বাস্তবে অনসমিয়া তথা বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতি উপেক্ষা, বঞ্চনা ও বৈষম্যমূলক। এই প্রেক্ষাপটেই সমগ্র ব্রহ্মপুত্র এলাকায় শুরু হয় ভাষিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং সেই সঙ্গে উৎপীড়ন ও দাঙ্গা।

আসামের বিধানসভাতেও অসমিয়াকরণের প্রচেষ্টা শুরু হয় ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত বিধানসভায় অনসমিয়াদের বেলায় বাংলা, ইংরেজি কিংবা হিন্দি ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপনের বিধান ছিল। ঐ বছর নতুন আইন পাশ করে তা কেড়ে নেওয়া হয়। ঐ আইনে বলা হয় : 'The business of the House shall be transacted in Assamese or in English.' তবে ঐ বিধানে তখনও অধ্যক্ষের অনুমতিক্রমে মাতৃভাষায় বক্তব্য পেশের সুযোগ ছিল। কিন্তু ১৯৫৪ সালে বিধানসভায় একমাত্র অসমিয়াকে রাজ্যের ভাষা হিসাব গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপিত হলে তাতে আসাম রাজ্যের সর্বত্র অনসমিয়া ভাষীদের মধ্যে বিতর্ক ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অবশ্য বেসরকারিভাবে উত্থাপিত ঐ প্রস্তাব তখন বিবেচনা না করে স্থগিত রাখা হয়।

ভাষা আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে ১৯৬০-এর এপ্রিলে। ২১ ও ২২ এপ্রিল আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির এক সভায় অসমিয়াকে আসামের একমাত্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এর পর পরই আসাম প্রদেশের শাসকবর্গ উগ্র ভাষাপ্রেমের পক্ষে অবস্থান নেন এবং অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করার অপচেষ্টায় সক্রিয় তৎপরতা শুরু করেন। এর ফলে অনসমিয়া বিশেষত বাংলা ভাষাভাষী বাঙালিদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং সরকারি দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ২১ জুন ১৯৬০ শিলচরে 'নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন'-এর উদ্যোগে এক বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়। লোকসভা সদস্য শ্রীদ্বারিকানাথ তেওয়ারীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঐ সভায় আলতাফ হোসেন মজুমদার, নন্দকিশোর সিংহ, নিবারণচন্দ্র লস্কর, রথীন্দ্রনাথ সেন, গোলাম ছগির খান, শরৎচন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ বিশিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দ গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং প্রতিবাদ জানান। সভায় অসমিয়াকে রাজ্যভাষা করার আন্দোলনের নামে বাঙালিদের উপর হামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করা হয়।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনকে সংহত রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে ২ ও ৩ জুলাই ১৯৬০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় 'নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন'। এই সম্মেলনে আসাম রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পঁচিশ হাজার নরনারী সমবেত হয়। বিভিন্ন জাতি, উপজাতি ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্মেলন পরিণত হয় মহাসম্মেলনে। সভায় আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে একমাত্র অসমিয়ার প্রবর্তন স্থগিত রেখে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়।

এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর পরই সমগ্র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাব্যাপী শুরু হয় দাঙ্গা হাঙ্গামা। অসমিয়াপন্থী উগ্র দাঙ্গাবাজরা পথে নামে। নির্বিচারে বহু বাঙালির বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। লুঠতরাজ, হত্যা ও ধর্ষণ চলে অসমিয়া ভাষা আন্দোলনের নামে। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নেতৃত্ব এতে পরোক্ষভাবে মদত জোগায়। যদিও কংগ্রেসের সবার এতে সমর্থন ছিল না। প্রশাসনের এক শ্রেণীর উগ্র জাতীয়তাবাদী কর্তাব্যক্তি ও পুলিশ কর্মকর্তা এসব ঘটনায় নেপথ্যে ইন্ধন জোগান।

১০ অক্টোবর আসাম বিধান পরিষদে আসাম সরকারি রাজ্যভাষা বিল উত্থাপন করা হয়। ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত এ বিল নিয়ে আলোচনা চলে। ২৪ অক্টোবর সকল সংশোধনী প্রস্তাব, অনুরোধ-নিবেদন উপেক্ষা করে রাজ্যভাষা বিল চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। এভাবে আসামের বিভিন্ন অসমিয়া উপজাতি গোষ্ঠী ও দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী লক্ষ লক্ষ বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার দাবি উপেক্ষিত ও অস্বীকৃত হয়। এর প্রতিবাদে অনেক সংসদ সদস্য সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। মাতৃভাষার অধিকার বঞ্চিত লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষোভে, দুঃখে, উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। ১৯৬০-এর ৬ ও ৯ নভেম্বর নিখিল আসাম বঙ্গ ভাষাভাষী সম্মেলনের উদ্যোগে কনভেনশন আহ্বান করা হয়। কনভেনশন সংবিধান স্বীকৃত ভাষা-অধিকার সুরক্ষা করা ও মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায় সহ বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়।

বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ক্রমেই সংহত রূপ নিতে থাকে। ১৯৬০-এর ১৮-২০ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় কাছাড় উপত্যকা তথা বরাক উপত্যকার বাঙালি নাথ যুগী সম্প্রদায়ের ৩৬তম বার্ষিক অধিবেশন। ঐ অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে অসমিয়া ভাষার মতো সরকারি মর্যাদা দেওয়া না হলে বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্ত করা হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় কাছাড় জেলা জনসম্মেলন। সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষা করার দাবি তোলা হয়। অন্যথায় সমগ্র জেলায় অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১৪ এপ্রিল ১৯৬১ নববর্ষের দিনে কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পালিত হয় 'সংকল্প দিবস'। সংকল্প করা হয় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার। এই সংকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম হিসাবে ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয় পদযাত্রা। দুই সপ্তাহ ধরে পদযাত্রীরা ২২৫ মাইল পথ অতিক্রম করেন। গ্রামে গ্রামে বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে প্রচার চালান। ২ মে তাঁরা করিমগঞ্জে এসে পৌঁছলে তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

১৯ মে ভাষা আন্দোলনের অংশ হিসাবে কাছাড় জেলার সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। আগের রাতে করিমগঞ্জে সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয়ে চলে পুলিশি হামলা। আন্দোলন ঠেকাতে বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয় অনেক নেতা-কর্মীকে। সে খবর দাবানলের মতো রাতেই ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। শহর জেগে ওঠে উত্তেজনায়। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে জনতা নামে রাজপথে।

১৯ মে ভোর চারটায় শিলচর রেল স্টেশনে শুরু হয় সত্যাগ্রহীদের অবরোধ। জেলার সর্বত্র একই সময় থেকে সর্বাত্মক ধর্মঘট কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। দোকানপাট যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। কোর্ট-কাছারি, ডাকঘর, অফিস-আদালত সব কার্যালয়ের সামনে চলে পিকেটিং। গ্রেফতার বরণ করেন হাজার হাজার কর্মী।

আন্দোলনের ব্যাপকতা দেখে শাসকগোষ্ঠী মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। ভাষা আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য তারা বেছে নেয় চরম নির্যাতনের পথ। ঐ দিন দুপুর আড়াইটায় শিলচর রেল স্টেশনে তারা ধর্মঘটরত জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। শত শত লোক আহত হয়। গুলিতে শহীদ হন ১১ জন। এঁরা হলেন : শচীন্দ্র পাল, কানাই নিয়োগী, কমলা ভট্টাচার্য, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর ও সত্যেন্দ্র দেব।

১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলার পাকিস্তানে শাসকগোষ্ঠীর উগ্র ভাষানীতির মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন করে প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার [প্রমুখ], তেমনিভাবে ভাষা আন্দোলনের আর এক ইতিহাস রচিত হল বরাক উপত্যকায়। তাতে খচিত হল ১১ জন শহীদের নাম।

এই ঘটনায় সারা ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। প্রতিক্রিয়া হয় পূর্ব বাংলায়ও। ২১ মে শিলচর সহ সমগ্র কাছাড় জেলায় রেলকর্মীরা কর্মবিরতি পালন করেন। শিলংয়ে বিভিন্ন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন শোক পালন করে। শোক পালিত হয় জলপাইগুড়িতে। কলকাতায় তীব্র প্রতিবাদ ওঠে সভা, সমিতি, মিছিলে। শহীদ স্মরণে শোক ও শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়। ২৩ মে গৌহাটি, শিলং, জাফলং, আইজল ও আগরতলায় পালিত হয় প্রতিবাদ দিবস। বিভিন্ন বাম দল সম্মিলিতভাবে ২৪ মে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে পালন করে প্রতিবাদ দিবস। ২৪ মে বরাকের বুকে বিশ হাজার সত্যাগ্রহী আসাম সরকারের বিদ্বেষনীতির বিরুদ্ধে আমরণ সত্যাগ্রহের শপথ নেয়। ২৬ মে ঈদ উৎসবের দিন বরাক উপত্যকার সর্বত্র ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করে হত্যাকাণ্ডের নীরব প্রতিবাদে সামিল হয়। ২৯ মে পালিত হয় ভাষা শহীদ তর্পণ দিবস। শহীদের চিতাভস্ম নিয়ে অজস্র জনতা সামিল হয় মৌনমিছিলে।
. . .

একুশে ফেব্রুয়ারি ও বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদ
মুহম্মদ ইদ্রিস

একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশের চেতনা আন্তর্জাতিকীকরণের আবেগে আমরাও আপ্লুত। কিন্তু আমাদের এই ভূখণ্ডের বাইরে প্রতিবেশী ভারতে আসামের বাংলাভাষী অঞ্চল বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষা বাংলার অধিকার দাবি করে যে পনের জন তরুণ-তরুণী আত্মোৎসর্গ করে গেছেন, তাঁদের কথা আমরা একবারও স্মরণ করি না। বাংলা ভাষার জন্য যে-দেশে যিনিই শহীদ হোন না কেন তিনি প্রত্যেক বাঙালিরই আদর্শ। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মবলিদান বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে সার্থক হয়েছে। কিন্তু বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ ১৯৬১ সালের ১৯ মে, ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট এবং ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই তিন দফায় পুলিশের গুলিতে পনের জন শহীদ হন। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় এই শহীদরাও তো আমাদের ভাই-বোন। তাঁদের ভুলে যাওয়ার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মবলিদানের ফলে জিন্নাহ্‌র দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তানি জাতিতত্ত্বের বুনিয়াদ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। আর বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন হচ্ছে ১৮৭৪-এর বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯৪৭-এর বঙ্গভঙ্গের ঐতিহাসিক পরিণাম।

একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা সংগ্রাম থেকে বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথমত, আসামে বাংলাভাষীরা সংখ্যালঘু। পক্ষান্তরে, পূর্ববঙ্গের বাঙালির ছিল পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বরাকের ভাষা আন্দোলন সংখ্যালঘুর আন্দোলন আর বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন সংখ্যাগুরুর আন্দোলন। তাছাড়া, ভারতীয় সংবিধানে বিভিন্ন সংখ্যালঘু ভাষিক জনগোষ্ঠীর যে অধিকার সংরক্ষণ করা হয়, সেটাই বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শক্তি। অর্থাৎ বরাকের ভাষা আন্দোলন আসামের ভূমিপুত্র বাঙালির সংবিধান-স্বীকৃত অধিকার এবং একই সঙ্গে আসামের বহুভাষিক চরিত্র রক্ষার আন্দোলন। অন্যদিকে, পাকিস্তানের সংবিধান তখনও (বায়ান্ন সালে) রচিত হয়নি। পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর এমন একটি ভাষা (উর্দু) চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছিল, যে ভাষা পূর্ববঙ্গে তো বটেই, গোটা পাকিস্তানে কারও মাতৃভাষা ছিল না। সাতচল্লিশে ভারত বিভাজনের সুবাদে ভারত থেকে পাকিস্তানে আগত মুষ্টিমেয় লোকই মাত্র উর্দুতে কথা বলতেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ভাষাকে উপেক্ষা করে তাদের ওপর উর্দু চাপিয়ে দিয়ে বাঙালির অস্তিত্ব-বিনাশের সুদূরপ্রসারী এক চক্রান্ত প্রতিহত করতে একশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রাঙিয়েছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা।

দ্বিতীয়ত, বহুভাষিক আসাম রাজ্যের অসমিয়াকরণের প্রতিক্রিয়ায় ইতোমধ্যে আসাম ভেঙে কয়েকটি স্বতন্ত্র রাজ্য গঠিত হওয়ায় বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের সঙ্গে অনসমিয়াভাষী গোষ্ঠীসমূহের যোগসূত্রও ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে, আসামে বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম হয়ে দাঁড়ায় বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন। তৃতীয়ত, পূর্ববঙ্গে (পূর্ব পাকিস্তানে) মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য একবারই শোণিত তর্পণ হয়েছিল। পক্ষান্তরে, মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় বরাক উপত্যকায় বাহাত্তরের সতেরই আগস্ট দু'জন এবং ছিয়াশির একুশে জুলাই দু'জন শহীদ হন। উনিশে মে, সতেরই আগস্ট ও একুশে জুলাই সত্ত্বেও বরাক উপত্যকার বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার শেষ কোথায়, কেউ জানে না। একুশে ফেব্রুয়ারির সংগ্রাম পরিণতি লাভ করেছে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র অর্জনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে বাংলাভাষা রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাষা। যে ভাষার রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই সেই ভাষা অস্তিত্ব হারানোর আশঙ্কা থেকে মুক্ত নয়। আসাম তথা বরাক উপত্যকার বাংলাভাষার রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই।

বরাকের পনের জন ভাষাশহীদ এবং উনিশে মে, সতেরই আগস্ট ও একুশে জুলাই ভাষাশহীদ দিবসগুলি সম্পর্কে এই প্রজন্মের বাংলাদেশ কিছুই জানে না। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানেও বরাকের ভাষাশহীদদের নাম কেউ উচ্চারণ করে না। অথচ একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বরাকের বাঙালি। সেদিন বিশ্বের যেখানেই বাঙালি ছিলেন প্রত্যেকেই বাঙালির স্বাধীনতার সপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এই অভূতপূর্ব ঐক্য রাজনীতির চোরাবালিতে হারিয়ে গেল কেন? বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামও নির্বাচনী রাজনীতির বেড়াজালে আটকে গেল। আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে অসমিয়ার সঙ্গে বাংলাভাষাকেও স্বীকৃতি দানের দাবি আজও উপেক্ষিত।

বরাক উপত্যকার ভাষাশহীদ পরিচিতি :

১. কমলা ভট্টাচার্য :
বাংলাভাষা সংগ্রামের একমাত্র মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েই ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ষোল বছর বয়সে তিনি শহীদ হন। পিতৃহীন কমলা ছিলেন অবিবাহিতা, থাকতেন ভাই রামরমণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে শিলচর শহরে। তাঁদের পরিবার ১৯৫০ সালে সিলেট ছেড়ে কাছাড়ে আশ্রয় নেন। তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে কমলা ছিলেন তৃতীয়।

২. শচীন্দ্রমোহন পাল :
মাত্র উনিশ বছর বয়সে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য বুক পেতে নিয়েছিলেন আসাম সরকারের বুলেট শচীন্দ্র পাল। তাঁদের পূর্বনিবাস ছিল হবিগঞ্জ মহকুমার নবিগঞ্জের সন্দনপুর গ্রামে। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে শচীন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। কাছাড় হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেন।

৩. কানাইলাল নিয়োগী :
আদিনিবাস ময়মনসিংহ জেলার খিলদা গ্রামে। মেট্রিক পাশ করে ১৯৪০ সালে রেলে চাকরি নেন। স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে শহীদ হন। তখন তাঁর মা শান্তিকণা নিয়োগীর বয়স ৭০ বছর। পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল নিয়োগী আগেই প্রয়াত।

৪. কুমুদ দাস :
পিতা কৃষ্ণমোহন দাস মৌলভিবাজারের জুরি থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কাছাড়ে যান। মায়ের মৃত্যুর পর আট বছর বয়সে কুমুদ দাস ত্রিপুরায় মামার বাড়িতে থেকে এম.ই. পর্যন্ত পড়ে গাড়িচালকের পেশা গ্রহণ করেন। পরে শিলচরের তারাপুরে চা-দোকানে বয়ের কাজ নেন। বৃদ্ধ পিতা, চার বোন ও এক শিশু ভাইকে নিয়ে সংসার ছিল তাঁদের। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন কুমুদ দাস।

৫. তরণী দেবনাথ :
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সাতচল্লিশে ভারত বিভাগের সময় শিলচরে গিয়ে বসবাস [শুরু] করেন পিতা যোগেন্দ্র দেবনাথ। মৃত্যুকালে বয়ন ব্যবসায়ী তরণীর বয়স ছিল মাত্র একুশ বছর।

৬. হীতেশ বিশ্বাস :
বাস্তুহারা হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পিতৃহীন হীতেশ বিশ্বাস মাত্র বার বছর বয়সে ত্রিপুরার খোয়াই শহরের উদ্বাস্তু কলোনির বাসিন্দা হন। মা, ছোট ভাই ও এক বোনের সংসার ছিল তাঁদের। শিলচর শহরে ভগ্নিপতির বাসায় অবস্থানকালে মাতৃভাষার জন্য জীবনদান করেন।

৭. চণ্ডীচরণ সূত্রধর :
পিতৃহীন চণ্ডীচরণ সূত্রধর ১৯৫০ সালে হবিগঞ্জের জাকেরপুর গ্রাম থেকে মামার সঙ্গে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেন শিলচরে। পড়াশোনা এম.ই. পর্যন্ত। জীবিকা হিসেবে পৈতৃক বৃত্তি কাঠমিস্ত্রির কাজেই নিয়োজিত করেন নিজেকে। মাত্র বাইশ বছর বয়সে ভাষার জন্য আত্মদান করেন। তিনি তখন একা শিলচরের রাঙ্গির খাড়িতে বাস করতেন।

৮. সুনীল সরকার :
ঢাকার মুন্সিবাজারের কামারপাড়া থেকে ভারত বিভাজনের বলি হয়ে শিলচর শহরের নূতন পট্টিতে গিয়ে ঘর বাঁধেন [সুনীল সরকারের] পিতা সুরেন্দ্র সরকার। ব্যবসায়ী সুরেন্দ্রের তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে সুনীল ছিলেন সবার ছোট। মাত্র এম.ই. পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন সুনীল।

৯. সুকোমল পুরকায়স্থ :
করিমগঞ্জের বাগবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা পিতা সঞ্জীবচন্দ্র পুরকায়স্থ ডিব্রুগড়ে ব্যবসা করতেন। অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা করার আন্দোলনের নামে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ১৯৫৯ সালে 'বঙ্গাল খেদা' অভিযানের শিকার হয়ে সপরিবারে স্বগ্রামে চলে আসেন। ভাষা সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়ে মাতৃভাষার ঋণ শোধ করেন সুকোমল।

১০. বীরেন্দ্র সূত্রধর : শৈশবে বাস্তুহারা হয়ে পিতামাতার সঙ্গে নবিগঞ্জের [হবিগঞ্জের?] বহরমপুর গ্রাম থেকে শিলচর যান। জীবিকার অন্বেষণে বর্তমান মিজোরামের রাজধানী আইজল শহরে গিয়ে কাঠমিস্ত্রির পেশা অবলম্বন করেন। বিয়ে করেন ত্রিপুরার ধর্মনগরে। পরে কাছাড় জেলায় অবস্থিত মণিপুর চা বাগানের কাছে ঘর ভাড়া নেন। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে ১৮ বছরের বিধবা স্ত্রী ও এক বছর বয়সী কন্যা রেখে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে আত্মদান করেন তিনি। শিলচর রেল স্টেশনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে ২০ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

১১. সত্যেন্দ্রকুমার দেব :
মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে মাতৃভাষার বেদীমূলে জীবন উৎসর্গ করেন। উদ্বাস্তু হয়ে ত্রিপুরায় নূতন রাজনগর কলোনিতে তিন বোন ও মাকে নিয়ে আশ্রয় নেন পিতৃহীন সত্যেন্দ্র। মা ও বোনকে সেখানে রেখে জীবিকার অন্বেষণে শিলচরে গিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। পড়াশোনা ছিল প্রাইমারি পর্যন্ত। তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয় ২০ মে শিলচর রেল স্টেশনের পুকুর থেকে।


আমার বোনের রক্তে রাঙানো ….. ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য্য স্মরণে

লিখেছেনঃ মানস রায়

কমলা

ভূমিকা
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। সেটাও ফেব্রুয়ারী মাস। সন্ধেয় আড্ডা জমেছে শহর কলিকাতায়। আমার মতন পাতি আড্ডাবাজের সঙ্গে বেশ কিছু নামী-অনামী বুদ্ধিজীবি, নারীবাদী, পরিবেশবাদীরাও আছেন। ফেব্রুয়ারী মাস তাই ভাষা আন্দোলনের কথাও উঠল। কলকাতায় ভাষা আন্দোলনের প্রভাব নিয়েও তর্ক হল, কার্জন পার্কে ভাষা শহীদদের নামে কবর সম কালো বেদীটির কোন শিল্পমূল্য আছে কিনা সেই প্রশ্নও করল কেউ। বেশি কচকচানি হয়ে যাচ্ছে দেখে বন্ধুবর কল্লোল তার আবেগমথিত গলায় গান ধরেছিল, "আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী"।

কল্লোলের গান একটু এগিয়েছে তখনই আমার বোকাবন্ধু সত্য মিত্র মিনমিন করে বলেছিল, আচ্ছা কেউতো এমনো লিখতে পারত …. 'আমার বোনের রক্তে রাঙানো …' কথা শেষ করতে পারেনি বেচারা, হইহই করে উঠেছিল সবাই। এ কেমন কথা। যারপরনাই বিরক্ত হয়েছিলেন নারীবাদী নেত্রী। এখানে বোনের কথা আসছে কোত্থেকে ? সমতার জন্য জবরদস্তি নারীশহীদ বানাতে হবে নাকি। ওহে মুর্খ, বাংলাভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল যারা তারা সবাই পুরুষ। তুমি হিন্দুর ছেলে মুসলমান নামের লিঙ্গ জ্ঞান নেই।

সত্য তবু বলার চেস্টা করেছিল, ২১শে ফেব্রুয়ারী নয় ১৯শে মে, বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল এক নারী, ষোল বছরের কিশোরী, কমলা ভট্টাচার্য্য, ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিল, রেজাল্ট দেখে যেতে পারেনি……। কিন্তু ১৯শে মে পর্যন্ত বলার পর খুব গম্ভীর গলায় সত্যকে থামিয়ে ছিলেন আড্ডার সবচেয়ে মান্যগণ্য ব্যক্তি, এক বিখ্যাত বাংলা পত্রিকার সম্পাদক। বলেছিলেন, ওটা ১৯শে নয় হবে ১৩ই মে। কবি সুকান্তর মৃত্যু দিবস।সুকান্তর মৃত্যু, অকালমৃত্যু কিন্তু তাকে শহীদ বলাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। সম্পাদক মশাই আরো জানিয়েছিলেন যে ফেব্রুয়ারীর মতন মে মাসও বাংলা ভাষার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ মাস – রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল, দুজনের জন্মই মে মাসে।

বলা বাহুল্য, সম্পাদক মশাই জানতেন না যে আরো একটি কারণে মে মাস বাংলা ভাষার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে মে মাসের ১৯ তারিখে ভারতের অসম প্রদেশের কাছাড় জেলার সদর শিলচর শহরে বাংলা ভাষার সরকারী স্বীকৃতি দাবীর আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন এগার জন। সেই একাদশ শহীদের একজন এবং একমাত্র নারী কমলা। কমলা ভট্টাচার্য্য সম্ভবতঃ বাংলা ভাষার জন্য প্রাণদাত্রী একমাত্র নারী।…… এই তথ্যটি পশ্চিম বাংলার বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবির, বিশেষ করে শিল্প সাহিত্যের সংগে জড়িত মানুষদের, অজানা। কতিপয় যারা জানেন তারা না জানার ভান করেন বা এড়িয়ে যান। তাই ভিয়েতনাম, লাতিন আমেরিকা, প্যালেস্তাইনের জন্য পাতা ভরানো বাঙালী কবির কলমে (ব্যতিক্রম বনফুল, মনীষ ঘটক)শিলচরের স্থান হয় নি। পশ্চিম বাংলার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন গবেষণাপত্র লেখা হয় নি। কলকাতায় ২১শে স্মরণে বেদী আছে কিন্তু ১৯শে ….. সেটা আবার কি? পশ্চিম বাংলায় যখন এই অবস্থা তখন বাংলাদেশের কাছে কিছু আশা না করাই স্বাভাবিক।

সেই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে দু চার কথা
বাংলাভাষী শ্রীহট্ট জেলা ১৮৭৪ খ্রীস্টাব্দে অসম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। রবীন্দ্রনাথ তাই লিখেছিলেন, 'মমতাবিহীন কালস্রোতে/ বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে/ নির্বাসিতা তুমি/ সুন্দরী শ্রীভূমি'। অসমে এক সময় সরকারী ভাষা ছিল বাংলা। পরে অসমীয়া প্রধান সরকারী ভাষা ঘোষিত হলেও সমগ্র অসমে বাংলা চালু ছিল সরকারী স্তরে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এক বিতর্কিত গণভোটে শ্রীহট্ট জেলাকে অসম থেকে বিছিন্ন করে পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, শুধু কাছাড় অংশ ভারতে থেকে যায় অসমের একটি জেলা হিসেবে। একশ শতাংশ বাংলাভাষী কাছাড় জেলায় বাংলাই ছিল প্রধান সরকারী ভাষা। ১৯৬০ সালে অসম সরকার অসমীয়াকে একমাত্র সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এই ঘোষণার বিরুদ্ধে বাংলা ও অনান্য স্থানীয় ভাষার স্বীকৃতির দাবীতে কাছাড়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক প্রবল ভাষা আন্দোলন।

প্রতিক্রিয়ায় অসমীয়া গরিষ্ঠ অঞ্চলে বাঙালীদের ওপর নেমে আসে প্রচন্ড অত্যাচার। অসমের বাংলাভাষী মুসলমানরা তাদের মাতৃভাষা অসমীয়া ঘোষণা না করলে তাদের পাকিস্তানে পাঠানো হবে এই জুজু দেখান হয় (যে প্রচেস্টা আজও অব্যাহত। ২০১১ সালের সেন্সাসে বাংলাভাষী মুসলমানরা যাতে তাদের মাতৃভাষা অসমীয়া ঘোষনা করেন তার জন্য সম্মেলন টম্মেলনও হচ্ছে এবং অসমের বাংলাভাষী মুসলমানরা এ ব্যাপারে বর্তমানে কিছুটা দিধা বিভক্ত।এই বিষয় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি প্রবন্ধের দাবীদার।)এবং বাংলাভাষার আন্দোলন বাঙালী হিন্দুর মুসলিম বিরোধী কার্য্যকলাপ বলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো হয়। দাঙ্গা দমন পীড়নকে অগ্রাহ্য করে বাংলাভাষার দাবীতে রাস্তায় নামেন কাছাড় জেলার সর্বস্তরের মানুষ।

১৯৬১র ১৪ই এপ্রিল (১লা বৈশাখ)পালিত হয় সংকল্প দিবস। ১৯শে এপ্রিল থেকে পদযাত্রা শুরু হয় সারা জেলা জুড়ে। ১৮ই এপ্রিল ছাত্র সমাবেশ, বিশাল মশাল মিছিল হল করিমগঞ্জে, শিলচরে (ফেব্রুয়ারীর আন্দোলনের মত এখানেও ছাত্ররা সামনের সারিতে)। পরদিন, ১৯শে মে, পালিত হবে অসহযোগ দিবস, স্তব্ধ হবে সারা কাছাড়, বাংলা ভাষার জন্য নিবেদিত হবে এগারটি প্রাণ, বাংলার নারীর মুখ উজ্জ্বল করবে কমলা ভট্টাচার্য্য।

কমলার কথা
দেশ ভাগের বলি কমলাদের পরিবার শ্রীহট্ট থেকে কাছাড়ে আসে ১৯৫০ সালে। পিতা মৃত। অভাবের পরিবারে দুবেলা পেটভরা অন্নের সংস্থান ছিল না। চার বোন, কমলা তৃতীয়। তিন ভাই – দুজন কমলার বড়, বকুল ছোট। দ্বিতীয় বোন (সেজদি) প্রতিভা এক স্কুলের শিক্ষিকা, তার আয়ে কোনমতে চলে। পড়ার বই, লেখার খাতা কেনার সামর্থ নেই, শতছিন্ন পোষাকে স্কুলে যাতায়াত। অনেকেই পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার পড়ামর্শ দিয়েছিল কমলাকে। কমলার এক গোঁ, গ্র্যাজুয়েশন আমি নেবই। সেই গোঁ থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসা, আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেও।

ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ। পরদিনই পিকেটিংএ যাওয়ার জন্য তৈরী কমলা। আজকে তো এক বিশেষ দিন, আজকের পিকেটিং সারা কাছাড় সারা কাছাড় স্তব্ধ করে নেহেরু-চালিহাদের (চালিহা অসমের ততকালীন মুখ্যমন্ত্রী)জানিয়ে দেবে ভাষার জন্য বাঙালী সব কিছু করতে পারে। কমলাকে আটকায় মা সুপ্রভাসিনী, যাসনে বাইরে আজ। কিন্তু আজ কে কাকে আটকাবে? সেজদি স্কুলে যাওয়ার জন্য কেঁচে ধুয়ে রাখা কাপড়টা না বলেই পড়ে নেয় কমলা। দলবল এল বলে। সেজদি জানতে পেরে খুব রাগ করবে, ভাল কাপড় ওরই বা বেশি কোথায়। যাক সে কথা পরে ভাবা যাবে। ২০-২২ জন মেয়ের একটা দল এসেছে বাড়িতে, কমলাকে ডাকতে। এবার সেজদিও মানা করে, কাচা কাপড়টাও ওর নজরে এসেছে। কিছু হবে না মাসীমা, সেজদি আপনি একদম ভাববেন না। আমরা থাকব রেলস্টেশনে। সকালের ট্রেন আটকে দিলে সারা দিন সব বন্ধ। পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে কমলা। ইতিমধ্যে ছোটবোন মঙ্গলাও সাথ নিয়েছে। চল, তুইও চল। কিছু খেয়ে গেলে হত না? মার মুখ দেখে বুঝল ঘরে কিছু নেই। খাবার দিতে না পারলেও মা কমলাকে একটা বড় কাপড়ের টুকরো দিয়ে দিলেন। সাথে রাখিস, কাঁদানে গ্যাস ট্যাস ছোড়ে যদি।

বাড়িতে মন টেকেনা মায়ের। শুধু মেয়ে দুটো নয়, ছোট ছেলে বকুল, নাতি বাপ্পাকে নিয়ে কখন পিকেটিং এর দিকে হাঁটা দিয়েছে টের পান্নি। নাতি বাপ্পা বড় মেয়ে বেনুর ছেলে। বেনু নার্সের চাকরির ট্রেনিং এ গেছে শিমুলগুড়ি। এবার সুপ্রভাসিনী নিজে বেরুলেন। ছেলে মেয়ে নাতি সব বাইরে, হচ্ছেটা কি? নিজে একবার না দেখলে মন মানেনা। রোদ চড়েছে, রাস্তা খালি, পুলিশের একটা গাড়ি ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। কোথায় যাবেন। মেয়েরা স্টেশনে যাবে বলেছিল, ওখানেই যাওয়া যাক। স্টেশনে পাওয়া গেল ছোট ছেলেকে আর নাতিকে। ওদের দুজনকেও পুলিশ ধরেছিল, আবার ছেড়ে দিয়েছে। কতজনকে ধরবে, রাখবে কোথায় ? মাকে দেখে স্টেশনের এক কোন থেকে উদয় হল দুই মেয়ের। একি, মা তুমি ব্লাউজ টাউজ না পরে শুধু কাপড় জড়িয়ে এখানে এসেছ কেন? কমলা বকা দেয় মাকে। ধুলো ভরা পা দেখে স্টেশনের কল থেকে কল এনে পা ধুইয়ে দেয়। এবার বাড়ি যাও তুমি, এখানে সব শান্ত।

তোরা যাবিনা? যাব, আর একটা ট্রেন আটকালেই এখানের কাজ শেষ। ওটা আটকেই বাড়ি ফিরব।
ছোট ছেলে আর নাতিকে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোন সুপ্রভাসিনী।

খানিক্ষণের মধ্যে স্টেশনে আবহাওয়া পালটে যায়। সকাল থেকে কতগুলো ট্রেন আটকানো হল। কোন গন্ডগোল নেই। সবাই মিলে বাংলাভাষা চালু করার স্লোগান দিয়ে রেল লাইনে বসে পড়লেই হলো। এবার যেন অন্যরকম। পুলিশের সংখ্যা হঠাত বেড়ে গেছে স্টেশনে। ওরা লাঠি আর বন্দুকের বাট দিয়ে মারতে শুরু করল আন্দোলনকারীদের। কিন্তু পিকেটিং ছেড়ে নড়ছে না কেউ। মার, কত মারবি।

হটাত কমলার কানে এল চীতকার, মঙ্গলার গলা। ধনদি বাঁচাও। ধনদি মানে কমলা। পুলিশের লাঠির ঘায়ে লুটিয়ে পড়েছে মঙলা। কমলা এগিয়ে যায় বোনকে সাহায্য করতে। লাঠির সাথে গুলিও চালানো শুরু হয়েছে তা লক্ষ্য করেনি কমলা। উঠে দাঁড়িয়ে বোনকে সাহায্য করতে যাওয়া উচিত হয় নি কমলার। কিন্তু উচিত অনুচিত ভাবার সময় কই, মঙ্গলাকে ভীষণ ভাবে মারছে পুলিশ। ছুটে যায় কমলা। যাওয়া হয় না।

পুলিশের বুলেট কমলার ডান চোখের পাশ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি চুরমার করে দেয়। আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ে কমলা। কমলা হয় শহীদ কমলা ভট্টাচার্য্য। বাংলা ভাষার নারী শহীদ।

ছোট শহর শিলচর। রেলস্টেশনে গুলি চলেছে। নিহত অনেক, আহত আরো প্রচুর। মানুষ ভীড় করে হাসপাতালে। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে কমলার গুলি লেগেছে। জীবিত না মৃত নিশ্চিত নয় কেউ। হাসপাতাল ঘিরে রেখেছে পুলিশ, মেয়ের দেখা পেলেন না সুপ্রভাসিনী। কমলার সঙ্গীরা কান্নায় ভেঙে পড়ে তার সামনে। নিয়ে গিয়ে ছিলাম আপনার মেয়েকে, ফেরত আনতে পারলাম ন।পাথরের মতন নীরব হয়ে বসে থাকেন তিনি। হঠাত মনে পরে মঙ্গলার কথা মঙ্গলা কোথায়? মঙ্গলার কথা কেউ বলছে না কেন?

মঙ্গলাও তখন হাসপাতালে। পুলিশের লাঠি ও বন্দুকের কুঁদোর আঘাতে বীভতসভাবে আহত, সজ্ঞাহীন। মঙ্গলার জ্ঞান ফিরবে একমাস পর, তারপর সারাজীবন বয়ে বেড়াবেন পুলিশী অত্যাচারের যন্ত্রণা, বেঁচে থাকবেন হার জিরজিরে রোগা শরীরে চিররুগ্ন হয়ে।

শহীদ পরিবারের কথা
কমলার মৃত্যুশোকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন মা সুপ্রভাসিনী। ঘুম হতো না। ঘুমালে স্বপ্নে ভাসে উঠত কমলার মুখ, তার জেদী ঘোষণা- গ্র্যাজুয়েশন আমি নেবই। ঘুম ভেঙে উঠে বসতেন। কাছাড়ের ডিসি এসেছিলেন আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে, নেন নি। যারা গুলি করে মেরেছে আমার মেয়েকে তাদের হাত থেকে নেব সাহায্য? কক্ষনো নয়। ছুটে যান বাড়ির ছাদে। মানসিক ভারসাম্য না থাকায় পড়ে ছাদ থেকে। সেই থেকে মনোবিকার চিরস্থায়ী। অবস্থার উন্নতি হবে ভেবে তাকে শিলচর থেকে গুয়াহাটি নিয়ে যান বড় ছেলে রামেন্দ্র ভট্টাচার্য্য। লাভ হয় নি। মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় মৃত্যু হয় শহীদ জননীর।

সেজদি ও মঙ্গল দুজনের বিয়ে হয়েছিল। তারাও চলে গিয়েছিলেন গুয়াহাটি। পুলিশী অত্যাচারের যন্ত্রণা সংগ ছাড়েনি সারা জীবিন। যার শাড়ি পড়ে শহীদ হয়েছিল কমলা, সেই সেজদিও পরবর্তি জীবনে মানসিক সমস্যার শিকার হন, বিশেষ করে কেউ কমলার কথা বললে সেই সমস্যা আরো প্রকট হত।

বড়দি বেনু চক্রবর্তী পরে আবার চেস্টা করেছিলেন কিছু সরকারী সাহায্য যোগাড় করতে এই বিধ্বস্থ পরিবারটির জন্য। পারেন নি। তবে বড়দি আসল দুঃখ স্বীকৃতির প্রশ্নে। বাংলাভাষার মূল স্রোতের কাণ্ডারীরা কমলার আত্মত্যাগকে কোনদিন যথচিত সন্মান দেন নি।

হয়তো 
হয়তো একদিন সুতানটী গ্রামের বাংলা শিল্প সাহিত্যের নটনটীরা বুঝতে পারবেন যে কমলা ও তা দশ সাথীদের জীবন বলিদান ২১শের চার শহীদের মতন চিরস্মরণীয়। হয়তো একদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ১৯৬১র ২১ শে মে নিয়ে গবেষণা করার মতন প্রাজ্ঞতা অর্জন করবে, হয়তো কফি হাউসের কোন কবি কলমে শিলচর স্টেশনের মহাকাব্য রচিত হবে, হয়তো পশ্চিম বাংলা মে মাস কে বাংলা ভাষার মাস হিসেবে চিহ্নিত করবে, হয়তো কোন নারীবাদী সাহিত্যে কমলার কথা লেখা হবে, হয়তো কলকাতা শহরের কোন রাস্তার নামফলকে শোভা পাবে কমলার নাম, হয়তো ……

তথ্যসূত্রঃ '১৯ এর শহীদেরা', দিলীপকান্তি লস্কর, লালনমঞ্চ প্রকাশনী, করিমগঞ্জ, অসম। প্রকাশনা ২০০২

http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=14387&plain=true


 বিষয় : ১৯ মে ভাষা শহীদ দিবস 
          বিভাগ : অন্যান্য
          শুরু করেছেন :কল্লোল
          IP Address : 125.241.38.233 (*)          Date:19 May 2012 -- 09:00 AM




Name:  সুশান্ত          

IP Address : 127.198.56.246 (*)          Date:19 May 2012 -- 09:10 AM

আমাদের অন্য সমস্ত স্বপ্ন ভাষার সঙ্গে বিদেয় নিয়েছে--
তারা সবাই শহীদ হয়েছে

সুশান্ত কর

শিলচরে বড় হবার সুবাদে ছেলেবেলা থেকে দেখতাম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর দিন কতক পরেই পাড়ায় পাড়ায় আরেকটি দিন উদযাপনের ধুম পড়ে যেত, সেতি ১৯শে মে। ১১ শহীদের ছবি একটা চেয়ার বা অস্থায়ীভাবে তৈরি বেদীর উপর রেখে ফুলে ধূপে সাজিয়ে রাখা হতো, কেউ কেউ পাশে বাংলা দেশাত্মবোধক গান মাইকে বাজিয়ে দিত, কেউ নয়। এই রীতিতে দিবস উদযাপনের রীতিটি বোধ করি শিলচরীয়, বা কাছাড়ি ব্যাপার। কেননা, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে ওমন দেখা যায় না। রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীতে বা নেতাজী জয়ন্তীতে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রভাত ফেরি হতো, স্কুল থেকেই যোগ দিতে বলা হতো। কিন্তু ১৯শের কোনো পথ চলাতে গেছি বলে মনে পড়ে না। কলেজে গিয়ে জেনেছি যে ১৯শের দিনে খুব সকালে শিলচর শ্মশানে জড়ো হওয়া আর বিকেলে গান্ধিবাগ শহীদ বেদীতে –একটি নিয়মিত প্রথা। পথ চলা টলা ইত্যাদি সাম্প্রতিক। সেই ১৯৮৬তে যখন ১৯শের ২৫ বছর উদযাপিত হয়েছিল , ওদিকে আবার সেবা সার্কুলারের বিরুদ্ধে উপত্যকা তথা গোটা অসম উত্তাল ছিল তখন হয়েছিল বটে এক বিশাল শোভাযাত্রা, এর পর বোধহয় কেন্দ্রীয়ভাবে ওমন শোভাযাত্রা সন্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ এবং ভাষা শহীদ স্টেশন দাবি সমিতির প্রচলন।
পাড়ায় পাড়ায় স্থায়ী শহীদ বেদি নির্মাণের ব্যাপারটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে ওই ১৯৮৬র পর, বিশেষ করে বাংলা পঞ্চদশ শতককে ( ১৪০০ সাল) যখন বরণ করা হচ্ছিল তখন থেকে। তার আগে শহরেও এতো শহীদ বেদী ছিল না, আর গাঁয়ে গঞ্জেতো মোটেও না। এখনো উধারবন্ধ, পাথারকান্দির মতো ছোট শহরগুলো বাদ দিলে উনিশ উপত্যকার কোনো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পালিত হয় কিনা আমার সন্দেহ আছে। বাংলাদেশে , পশ্চিম বাংলাতে, ত্রিপুরাতে বা অন্যত্র উনিশ পালনের ব্যাপারগুলোও অতি সাম্প্রতিক। এগুলো সম্ভবত প্রচার মাধ্যমের অবদান, অবশ্যি সংগঠিত উদ্যোগও রয়েছে। ১৯৮৬র আগে কবি লেখকেরাও ১৯ নিয়ে খুব যে লিখেছেন বলা যাবে না। শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর সেই বিখ্যাত পংক্তি "দশটি ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল, 'এই যে ঈশান কোণ" আশির দশকের আগে লেখা নয়। এই নিয়ে তাঁকে এবং তাঁর সময়ের অনেক কবি লেখককে আশির দশকে প্রচুর কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু ১৯৮৬র ২১ জুলাইর পর এটি প্রায় অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে যে যিনিই দুলাইন গদ্য বা পদ্য লিখবেন বরাক উপত্যকাতে তিনিই ১৯ কিম্বা ২১ নিয়েও অবশ্যই লিখবেন, পারলে বই করবেন শুধু এই একটি বিষয় নিয়ে। কার বই কত বেশি, কে আগে কে পরে, কে কত ইতিহাস জানেন কিম্বা জানাতে পারেন এই নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতাও দেখা গেছে। এতে অবশ্য কোনো লাভ হয় নি তা নয়, অঞ্চলটির ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভূগোল, অর্থনীত , রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে গভীর অধ্যয়নের আগ্রহও বেড়েছে প্রচুর। সুজিৎ চোধুরী, অমলেন্দু ভট্টাচার্য, সঞ্জীব দেব লস্কর, কামালুদ্দীন আহমেদ, আবুল হোসেন মজুমদার , ইমাদউদ্দীন বুলবুল প্রমুখের মতো বেশ কিছু পণ্ডিত গবেষকের আন্তরিক কাজের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে ১৯ শে মে, ২১ জুলাই বললে ভুল বলা হবে না। অনেকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাও ১৯শেরই দান। এটা পরোক্ষ সত্য। আসলে সত্তরের শেষ এবং আশির শুরুতে ছ'বছরের অসম আন্দোলনের দিনগুলোতে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের যে সব তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটিই বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনকে জোর দিয়েছিল। তবে কিনা, ষাটের ভাষা আইন নিয়ে বিবাদ এবং অসম আন্দোলন দুটোরই প্রেরণা ছিল অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদ—সেই সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৯শের সঙ্গে জুড়া যায় বইকি।
এহেন যে ১৯ , ২১ –সেই নিয়ে আমি নিজে কোনোদিনই লিখতে বিশেষ আগ্রহ বোধ করিনি। কেন, ব্যাপারটা খুলে বলি। ছেলে বেলার ১৯ উদযাপনের মানে বুঝতে বুঝতে যখন বড় হচ্ছি , ঠিক তখনইতো ১৯৮৬র ধাক্কা। নিজেও সেই লড়াইয়ের সামনের সারিতে ছিলাম। অগপ সরকার এসে অষ্টম শ্রেণি থেকে অসমিয়া পড়াটা বাধ্যতামূলক করে নির্দেশ দেবার পরে লড়াইতে যোগ দিইনি। বস্তুত, অসম আন্দোলনের বিভৎস দিনগুলোর উত্তাপের আঁচ পেতে পেতেই তো বড় হওয়া, তাই কলেজে যেতেই জড়িয়ে গেছিলাম ছাত্র আন্দোলনে। লড়াইর নামে তখন রক্ত গরম হয়ে পড়ত। অনেক দিনের খাটাখাটুনির পর, প্রথমে ১৯৮৫র অসম চুক্তি, এবং পরে ঐ সেবা সার্কুলারের পর এক বড় লড়াইয়ের পরিবেশ তৈরি হতে শুরু করল। ভেবেছিলাম এবারে একটা হেস্তনেস্ত হবে। নরসিং উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষাতে বসেছি আর দুটো পরীক্ষার আগে জেলা উপায়ুক্তের কার্যালয়ের সামনে এসে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে স্লোগান দিচ্ছি ---–এই স্মৃতি এখনো ভুলিনি আমি। লেখা পড়া লাটে উঠেছিল। রাতে বাড়ি থাকতে মানা করছিল, সহকর্মীরা নইলে পুলিশ তুলে নেবে।
দেখলাম ২১ জুলাই, ১৯৮৬ করিমগঞ্জে পুলিশের বেপরোয়া গুলি চালনা এবং অত্যাচারের পর আন্দোলনটা দ্বিগুণ তেজে জ্বলে উঠবে কই, উলটে নেতিয়ে গেল। সভা ডাকলে সংগঠনের সভাতেই লোক কম আসতে শুরু করল। এবং ১৫ আগষ্ট যখন সার্কুলারটি স্তগিত করল সরকার তখন সত্যি লড়াইটা মরেই গেল। তার পরেও, আমরা বহুদিন বহুভাবে সড়ক, বিশ্ববিদ্যালয়, বন্যা, বিদ্যুৎ, কৃষিঋণ ইত্যাদি নিয়ে লড়াই চালিয়ে গেছি, বরাক উপত্যকাতে সেদিনকার সংগঠনগুলো নানা ভাবে এখনো সেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু সংগ্রাম সমন্বয় সমিতি নামে যে মহা ঐক্যজোট সেবা সার্কুলারকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল সেটি আর অক্ষত ছিল না বেশি দিন। তখন জেনেছি, ১৯৬১র ১৯ মে'র পরেও ঘটনা তাই ঘটেছিল। একমাস পরে হাইলাকান্দিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতে সে লড়াই কলঙ্কিত হয়েছিল। ঠিক যেমন স্বাধীনতা কলঙ্কিত হয়েছিল দেশভাগে। আর পশ্চিম বাংলার বঙ্গবন্ধুরাও রাজ্যের শাসন হাতে পেয়ে আনন্দে মেতেছিল, তেমনি ঐ বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা বাংলা, গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে বাংলা, বাংলা মাধ্যমের স্কুল এমন কিছু ছুটকো দাবি আদায় করেই বরাক উপত্যকার লড়াই চুপ মেরে গেছিল। ব্রহ্মপুত্র তখন দিন গুনছিল ১৯৮৩র ১৮ ফেব্রুয়ারীর । যেদিন নরখাদকদের হাতে এক রাতে দু হাজারের বেশি নর নারী শিশু প্রাণ বলি দিয়ে দেবে। তার আগে পরে, বিচ্ছিন্ন নরহত্যার হিসেব নিলে সংখ্যাটা তিন হাজারের উপরে যাবে। তখন আর কেবল ১১ কিম্বা ৮৬র ২জনকে আলাদা করে মনে থাকে কী করে!
আমার এখনো মনে হয়, বরাক উপত্যকার বুদ্ধিজীবিরা যখন সেই পঞ্চাশ বছরের আগেকার ১১ শহীদের আর সেই বীরত্বপূর্ণ লড়াইএর বার্তা বরাক উপত্যকার বাইরে নিয়ে যান তখন আসলে নিজেদের তাঁরা বড় নয় , ছোটই করেন। কারণ নীরব স্রোতারা কী একবারের জন্যেও নিজের মনকে বা পাশের বন্ধুটিকেও জিজ্ঞেস করেন না, এর পরের পঞ্চাশ বছর আপনারা করলেনটা কী? আপনাদের প্রতিবেশী দেশ এবং রাজ্যের ইতিহাসেতো এর পর এর চেয়েও বহু বেশি রক্ত ঝরেছে, পালটে গেছে ভূগোল কিম্বা ইতিহাস! সম্প্রতি শিলচর রেল স্টেশনকে ভাষা শহীদ স্টেশন নামে নামাঙ্কিত করবার দাবিতে একটি লড়াই দানা বেঁধেছে। তাতে ভাষা ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের সমর্থণ দেখা গেছে। শ্রেণি নির্বিশেষে বলা যাবে না। সন্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ এবং ভাষা শহীদ স্টেশন দাবি সমিতি রয়েছে এই আন্দোলনের পুরোভাগে। এর জন্যে আইনত দরকার রাজ সরকারের অনুমোদনও আদায় করা গেছিল। কিন্তু গেল বছর এটি আটকে দিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। এই বলে যে, দাবিটি বুঝি 'আঞ্চলিক দেশপ্রেমে'র চিহ্নায়ক। গেল পঞ্চাশ বছরে যত দোষ দিসপুর ঘোসের ঘাড়ে চাপিয়ে অভ্যস্ত বরাক উপত্যকার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবির কাছে এটি বোধকরি অবিশ্বাস্য আঘাত। তাঁরা জ্বলে উঠবেন কৈ, মিইয়ে গেছেন। সংগঠন দুটো এখন প্রাণপণ করছে লড়াইকে জিইয়ে রাখতে। তাই, আপাতত, তাঁরা স্টেশনে খ্যাতনামা ভাস্কর স্বপন পাল নির্মিত শহীদ বেদী বসাবার পরিকল্পনা নিয়েছেন। এরকম কাজে মধ্যবিত্ত বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করে, তাদের জাগিয়ে চাগিয়ে রাখতে বেশ সুবিধে হয়। এই বলে আমি সংগঠনদুটোকে খাটো করছি না, মোটেও । তাদের বেচারি উপায় নেই অন্য।
আমি কি খুব হতাশার গল্প শোনাচ্ছি? মোটেও না। ১৯৬১ ভাষা আন্দোলন অসমের বাঙালির একার লড়াই ছিল না। এটা বরাক উপত্যকার থেকে যেসব ইতিহাস গ্রন্থ লেখা হয় তার প্রায় সবকটিতেই রয়েছে। মিজো, খাসি, বড়ো, মণিপুরি সব্বাই ছিলেন। তার পরে এদের অনেকেই স্বতন্ত্র রাজ্য নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, নিজেদের ভাষাকেও সরকারী ভাষার মর্যাদাতে প্রতিষ্ঠা দিলেন। প্রতিবেশি বাংলাদেশের কথা না হয় আনলামই না। আমাদের তাত্বিক তখন প্রবন্ধ লিখলেন, আমার মধ্যে ঠিক আঞ্চলিক বোর্জুয়া গড়ে উঠেনি। স্বশাসন কিম্বা স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবিতে এখনো লড়ছেন ডিমাছা, বডো, কার্বিরা। আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানেই আছি, বড়জোড় কাছাড়ে ছিলাম , এখন বরাক উপত্যকার মানুষ হয়েছি। এমন কি ১৯৭২এ মাধ্যম আন্দোলনে আমাদেরই লোকের হাতে করিমগঞ্জে শহীদ হয়েছিলেন বাচ্চু চক্রবর্তী, তাঁকে আমরা এখনো শহীদের মর্যাদা দেব কি দেব না এই নিয়ে গধুর তর্কে মাতি। ঘটনা হলো, অসমিয়ার সঙ্গে সেদিন যে ইংরেজিটাও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে থেকে যেতে পেরেছিল তার পেছনে মূল অবদানটি আসলে ছিল আহোমদের। ২১ জুলাইর করিমগঞ্জের গুলিচালনার পর সরকার আন্দোলনটিকে দমিয়েই দিয়েছিল। নতুন করে প্রস্তুতি নিচ্ছিল অসমের তাবৎ জনজাতীয় সংগঠনগুলো আটসুর নেতৃত্বে। তারা হুমকি দিয়েছিল ১৫ আগষ্ট , ১৯৮৬র আগে যদি সেবা সার্কুলার স্তগিত না হয় তবে তাঁরা ব্যাপক লড়াইয়ে নামছেন। ঠিক সেই দিনটিতেই স্তগিত হয়েছিল। জনপ্রিয় প্রচারে এগুলোর উল্লেখ মেলে না। জনপ্রিয় প্রচারটি হচ্ছে যে, লড়াইগুলো বাঙালির লড়াই, বাঙালি লড়েছে, রক্তও বাঙালি দিয়েছে।
এমন কি ভাগ্যিস, এতো দিনে ছোটখাটো এক মুসলমান মধ্যবিত্ত জগৎ গড়ে উঠেছে। অন্যথা, নব্বুইর দশকের শুরুতে ইমাদ উদ্দীন বুলবুলের ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে লেখা বইটির আগে নির্লজ্জের মতো, বহু কবি লেখকদের মুখেই এই প্রশ্ন শোনা যেত, ১১ শহীদের মধ্যে একজনও মুসলমান নেই কেন? এই প্রশ্নটি যে কেবল সাম্প্রদায়িক নয়, আত্মঘাতি---এই প্রশ্ন যে কৌতুহলকে উত্তর সন্ধানে প্ররোচিত করবার বদলে প্রস্তুত উত্তরকে দিয়ে প্রাচীর গড়ে তোলে এটি বুঝবার বোধটুকুও নেই এই সব বুদ্ধিজীবিদের।
শিলচর বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসংখ্যানুপাতে যথেষ্ট মুসলমান নেই কেন?---- এই প্রশ্ন তুলে এখন যখন, ছাত্র আন্দোলন হচ্ছে, এর মধ্যে বরং অনেকেই সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পাচ্ছেন সহজে। বস্তুত, এতেই আছে সেই প্রশ্নের উত্তর ----১১ শহিদের মধ্যে একজনও মুসলমান নেই কেন? এ কেবল দুটো সম্প্রদায়ের প্রশ্ন নয়, তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ অনেকটাই শ্রেণিরও প্রশ্ন বটে।
এবং আরো একটি ভেদ রয়েছে যেটি তাবৎ বৌদ্ধিক আলোচনাতে চাপা পড়ে থাকে। ভাষা নিয়ে আবেগটি মূলত মধ্যবিত্ত বিষয়। বরাক উপত্যকার শিলচর কেন্দ্রিক যে মধ্যবিত্ত সে মূলত দেশভাগের আগে পরে এই মাটিতে আসা লোকেদের নিয়ে গড়ে তোলা, যাদের শেকড় এখানকার মাটিতে খুব বেশি গভীরে গাঁথা হয়নি এখনো । আমি নিজেই যদি ছাত্র আন্দোলনের জড়িয়ে না থাকতাম এখানকার গ্রামাঞ্চল আর তার মানুষজনকে জানবার বুঝবার কোনো সুযোগই পেতাম না। আমাদের মুসলমান কিম্বা তপশিলি জাতি জনজাতি সহকর্মীরা যত সহজে এ গাঁয়ে ওগাঁয়ে সংগঠন গড়বার জন্যে আত্মীয় বন্ধুদের নাম করতে পারতেন, আমরা সিলেটি কায়স্থ, বামুন বন্ধুরা কিছুতেই তা করতে পারতাম না। আত্মগোপন করে আমাদের যদি গাঁয়ে যেতেও হতো, তবে যে পরিবেশ পেতাম সে আমাদের কাছে শুধু যে প্রাকৃতিক ভাবেই ভিন্ন তা নয় সাংস্কৃতিক ভাবেও অনেকটাই ভিন্ন হতো। অন্যথা, পুলশের গ্রেপ্তারি এড়িয়ে করিমগঞ্জ থেকে যারা পালিয়েছিলেন ২১ জুলাই বা তার পরে, তারা শিলচর হাইলাকান্দি ছড়িয়ে না গিয়ে গ্রামে ছড়াতে পারতেন এবং সেখান থেকে লড়াইকে নতুন উদ্যমে সংগঠিত করে পুণরুজ্জীবিত করতে পারতেন।
আমাদের এক কবির, ( দিলীপ কান্তি লস্কর) বহু পঠিত কবিতা আছে, "আমি কোত্থেকে এসছি তার জবাবে যখন বললাম, করিমগঞ্জ আসাম ... বাংলা ভাষার পঞ্চদশ শহিদের ভূমিতে আমার বাস/তিনি তখন এক্কেবারে আক্ষরিক অর্থই ভিরমি/ খাইয়ে দিয়ে আমাকে বললেন, ও! বাংলাদেশ ? তাই বলুন।"এই আক্ষেপটি সত্য। এবং সঙ্গত। কিন্তু আক্ষেপটির একটি মধ্যবিত্ত চরিত্রও আছে। প্রশ্নকর্তা কোনো বড় ভারতীয় শহরের প্রবাসী বাঙালি হবেন। উত্তরদাতাও তাই। আমার প্রশ্ন, এমন কবিতা অসমিয়া, নাগা, মণিপুরি ভাষাতেও যে লেখা যায়, লেখা যেত--- এই তথ্য আমরা জানিতো, জানলেও মানিতো? কারণ, বাঙালি ছাড়া আর যে কাউকে ভারতের যে কোনো প্রান্তে গেলে কখনো কখনো সত্যি সত্যি ভিসা পাসপোর্টও চেয়ে বসা হয়। কিন্তু সেগুলোও মধ্যবিত্ত সমস্যা। সেই মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু যে আকছার,
"ও! মুসলমান! তাই বলুন!" বলে ভিরমি খাইয়ে দেয়, এবং বরাকের বিপন্ন বাঙালি হিন্দুও তাতে এককদম পেছনে যায় না, আমরা তাই নিয়ে কবিতা খুব লিখেছি কি? লিখেছি, সাহিত্য ১১২ তে অরিজিৎ চৌধুরীর লেখা 'অদেখা তুলির আঁচড়' গল্প পড়ে দেখুন। গল্পের কথক কলকাতাতে ছ'শ স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট দরকষাকষি করাটা খুব দরকারী বোধ করছে। কেননা, আসামের যে বাংলাভাষি অঞ্চলে তার বাস সেখানে একদিকে ডি-ভোটার হবার ভয়তো অন্য দিকে মৌলবাদীদের দাপটে দেশভাগের আগের পূর্বপাকিস্তান হয়ে উঠেছে।
এখন, যারা কলকাতাতে ফ্ল্যাট কিনতে যেতে পারেন, তাদের কাছে ভাষা শহীদ স্টেশনের নামাকরণটা যত জরুরি, ব্রডগেজ লাইন ততোটা নয়। কারণ, রেলে চড়ে মজুর কিষাণ, বাবুরা সব প্লেনে যান! নামাকরণের লড়াইটা যাদের নেতৃত্বে হচ্ছে, তাদের তদবির দেখলেই বোঝা যায় ব্রডগেজের কথাটা সঙ্গে থাকলেও লোক আসছেন ঐ নামাকরণেরই মোহে, কেননা এ তাদের আত্মমর্যাদার লড়াই। কিন্তু ব্রডগেজ কেন হবে না বলে যারা রেল অবরোধ, পথ অবরোধ আর টি আই ইত্যাদি করছে তারা অন্য। কিছু ছাত্র সংগঠন , যাদের সঙ্গে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি নেই! যাদের সমাবেশে গান গাইতে পাঞ্জাবী পরে কেউ যাবেন না তেমন। সামাজিক ভেদ রেখা এখনও বিলীন হয় নি, তাই পঞ্চাশ বছরে ১৯শের অর্জন নেই তেমন বিশেষ। ঢাকা দিল্লী কলকাতা কিছু দৌড়ঝাঁপ ছাড়া ।
*** *** ***
বছর দুই আগে গোটা বিশ্বের কাগজগুলোতে শিরোনামে এসছিলেন বৃদ্ধা বোয়া। আন্দামানের 'বো' ভাষার শেষ ব্যক্তি মারা গেলেন। এখন শুনছি, প্রতিবেশি নেপালেও কুসুন্দা ভাষার শেষ মহিলা জ্ঞানী মাইয়া সেন জীবিত আছেন। তাঁর পরে এই ভাষা বলবার মতো আর কেউ বেঁচে রইবেন না। তো সমস্যাটি যে শুধু অসমীয়া ভাষার থেকেই নয় আমরা কি জানি না? জানি, আজকাল শোনা যাচ্ছে ইংরেজি ভাষার দাপটে আর সব ভাষা যেতে বসেছে! বো কিম্বা কুসুন্দা ভাষা ইংরেজি ভাষার দাপটে যেতে বসেছে এই কথা বর্তমান লেখক বিশ্বাস করি না। আর যতদিন কেবল নিজের ভাষাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকব আমরা ততদিন ইংরেজির দাপটকে যে হটানো যাবে তাও করি না বিশ্বাস । এই ছবিটাও স্পষ্ট হবে যদি শুধু বরাক উপত্যকার নজির দিই। ভারতের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে ইংরেজির বাইরেও দুই একটা ভাষা মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। অসমেও যেমন অসমিয়া। কিন্তু যে শিলচর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯শের অবদান বলে গৌরব করা হয়, তার প্রতিষ্ঠার প্রায় দুটো দশক অতিক্রান্ত হবার পরেও কোত্থাও স্নাতক স্তরে বাংলা মাধ্যম হিসেবে চালু হয় নি। স্নাতকোত্তরে সবচ' বড় বিভাগটি বাংলা এই নিয়ে গৌরব করা যেতে পারে, কিন্তু অন্য সমস্ত বিদ্যাচর্চাতে বাংলাকে অস্পৃশ্য করে রাখা হয়েছে। অথচ, ভারতের প্রচুর বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে স্নাতকোত্তর স্তরেও মাধ্যম কেবল ইংরেজি নয়। কেন? এই প্রশ্ন কাউকে তেমন করতে শোনা যায় না। কানাঘোষা শোনা যায়—বাংলা চালু করলেই মণিপুরিরাও দাবি করবে! আচ্ছা, বরাক বরাক উপত্যকা, বা অসমে বা পূর্বোত্তরে ওমন বিপন্ন ভাষাতো প্রচুর আছে। আমরা সেগুলোর সব ক'টাকে অন্তত প্রাথমিক স্তরে লেখা পড়ার ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার দাবিতে সরব হচ্ছি না কেন? পণ্ডিতজনে বলবেন, ওদের লিপি নেই, সাহিত্য নেই। আহা! যদি বৃদ্ধা বোয়া কিম্বা মাইয়া সেনের লিপি থাকত, কবিত্ব করতে জানতেন তাঁরা আমাদের বুদ্ধির গোড়ায় তবে বেশ করে সার পড়তে পেত!
বরাক উপত্যকার বৌদ্ধিক জগতে একটি বিশ্বাস প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে, "ধর্ম যে জাতীয়তার আধার হতে পারে না , পারে ভাষা—৭১এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তা প্রমাণ করেছে।" না হয়, আমরা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভয়াল রূপ সেদেশে দেখেছি, আমরা কি ভাষা জাতীয়তাবাদের রূপ দেখিনি ১৯শে মে, ২১ জুলাই, ১৮ ফেব্রুয়ারির অসমে? দেখেছি । দেখেও আমাদের চোখ ফিরিয়ে রেখেছি বাংলাদেশের দিকে। তাও সেদেশের পাহাড়ে তাকালে আমাদের ফোকলা স্বরূপ বেরিয়ে পড়ে। অসমিয়া উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে কিছুতেই কম ভয়ঙ্কর নয় ওদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তারপরেও আমরা বাংলাদেশে তাকাই, কেন? কারণ ও ভাবেই আমরা, এখনো স্বপ্ন দেখি আমাদের ভেতরকার ধর্মীয় ভেদকে ভুলিয়ে দেব, ঠিক যেমন ১৯০৫এর বঙ্গভঙ্গের বিরোধী নেতৃত্ব এক ব্যর্থ স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই একই নেতৃত্ব যেমন ১৯৪৭এ দেশভাগের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন আমাদেরও তেমনি ভেতরের স্বরূপ বেরিয়ে পড়ে সামান্য সুযোগ পেলেই। 'অদেখা তুলির আঁচড়ের গল্প'টিতো বললামই। সম্প্রতি দেখলাম শিলচর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পক্ষে ক'জন লেখক, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষাবিদ কাগজে চিঠি লিখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে প্রবল ছাত্র-শিক্ষক আন্দোলন হচ্ছে ক'মাস ধরে। তার মধ্যে আলাদা করে কিছু দলিত , সংখ্যালঘু সংগঠনও যোগ দিয়েছে। কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যমও হয়েছে সরব। দু'পক্ষই দাবি করছে বিশ্ববিদ্যালয় ১৯শের অর্জন । এর সম্মান ধুলিস্যাৎ করা হচ্ছে। যারা লড়াই করছে তারা উপাচার্যের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনছেন। যারা উপাচার্যের পক্ষে তারা আন্দোলন করিয়েদের বিরুদ্ধে। এমনটাই দেখা যায় যখন ডিব্রুগড় বা গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লড়াই হলে। পক্ষ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জাতিধ্বংসের অভিযোগ এনে স্বপক্ষ সবল করবার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই আন্দোলন বিরোধী বুদ্ধিজীবিরা যখন লেখেন, " ...দেখেছি কীভাবে সংবাদমাধ্যমের একটি আমাদের সর্বনাশের ডঙ্কা বাজাচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নানাভাবে প্রলোভিত করে সাম্প্রদায়িকতার পঙ্কিল পথে হেঁটে 'তাঁরা' আমাদের বিপর্যস্ত করতে চাইছেন...।" তখন বুঝি আমাদের সর্বনাশের ডঙ্কা বাজবার অপেক্ষা আছে কি আর? আছে শুধু কলকাতাতে দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরের ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন...। আমাদের অন্য সমস্ত স্বপ্ন ভাষার সঙ্গে বিদেয় নিয়েছে। তারা সবাই শহীদ হয়েছে।

http://www.guruchandali.com/guruchandali.Controller?portletId=8&porletPage=2&contentType=content&uri=content1337398234685#.UR5bKB2BlA0

মাতৃভাষার আন্দোলনঃ জানার আছে অনেক কিছুই


স্থানীয় খবরের উত্তেজনা দেখুন!ক্ষমতা দখলের লড়াই দেখুন।ইহার নামি পশ্চিমবঙ্গ।বড় রঙ্গ এই বঙ্গে

No comments:

Post a Comment