মালয়েশিয়ায় ১৩৯ গণকবর, ২৮ বন্দী শিবিরের সন্ধান ॥ মানবতার বধ্যভূমি
Janakantha
- মৃত মানুষের হাড়গোড় আর গলিত লাশ পাওয়া যাচ্ছে এসব কবরে
- এদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী। সংখ্যা শত শত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে
মোয়াজ্জেমুল হক/এইচ এম এরশাদ ॥ বিশ্ব বিবেক স্তম্ভিত। অবৈধ প্রক্রিয়ায় অভিবাসী প্রত্যাশী মিয়ানমারের শত শত দেশান্তরী রোহিঙ্গা ও ভাগ্যান্বেষী বাংলাদেশীর যে গণকবর ও বন্দী শিবির থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় আবিষ্কৃত হয়েছে তা রীতিমতো বিশাল এক বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। গত ২ মে থাইল্যান্ডে গণকবর ও বন্দী শিবির আবিষ্কৃত হওয়ার পর রবিবার থেকে এর পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্ত সংলগ্ন মালয়েশিয়ার পেরলিস প্রদেশের পেদাং বেসার ও ওয়াং কেলিয়ান এলাকায় একের পর এক যেভাবে গণকবর ও বন্দী শিবির বেরিয়ে আসছে তা মানবতার শেষ লজ্জাটুকুকেও ছাড়িয়ে গেছে। ওদের কেউ দেশান্তরী হয়েছিল উদ্ভাস্তু হয়ে যে কোন দেশে বেঁচে থাকার জন্য। আর কেউবা ভাগ্য ফেরানোর আশায় এ পথে যাত্রী হয়েছিল। গডফাদারদের নিয়োজিত দালালদের লোভের খপ্পরে পড়ে ওরা ভয়ঙ্কর সমুদ্র পথে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়া যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাগ্য তাদের পক্ষে সহায় হয়নি। ওদের অনেকের শেষ ঠিকানা হয়েছে গণকবরে। এই কবরের সংখ্যা এতই বেশি যে একে এখন বধ্যভূমিই বলা যায়।
নিজ নিজ জীবনমান উন্নত করার আশায় এই অবৈধ পথ তারা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু মানবপাচারকারীরা তাদের বাঁচতে দেয়নি। এমনকি অনেককে বন্দী শিবিরে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে মুক্তিপণ আদায় করার পরও তাদের স্থান হয়েছে গণকবরে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় বন্দী শিবির ও গণকবর আবিষ্কারের সাম্প্রতিক ঘটনা এখন সারাবিশ্বের শীর্ষ একটি খবর। কারণ মানবতা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। নিদারুণ নির্যাতনে ও নিষ্পেশনে তাদের শেষ ঠিকানা হয়েছে ভিনদেশের গভীর জঙ্গলে গণকবরে। বিশ্ব ইতিহাসে অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিয়ে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে এমন গণকবর ও বন্দী শিবিরের ঘটনা বিশেষভাবে ইতোমধ্যে স্থান করে নিয়েছে।
সোমবার মালয়েশিয়ার পুলিশ প্রধান খালিদ আবু বকর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, উল্লেখিত সীমান্ত এলাকায় গভীর জঙ্গলে আরও ১০৯টি গণকবর ও ১৪টি বন্দী শিবিরের খোঁজ মিলেছে। এর আগে রবিবার সে দেশের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা জানিয়েছিলেন, ৩০ গণকবর ও ১৪ বন্দী শিবিরের কথা। কিন্তু উদ্ধার তৎপরতায় এ পর্যন্ত গণকবর ১০৯ ও বন্দী শিবির ২৮-এ উন্নীত হয়েছে। পুলিশ প্রধান আবু বকর স্বীকার করেছেন গত ১১ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত সে দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পরিচালিত অভিযানে এসব গণকবর ও বন্দী শিবিরের সন্ধান পাওয়া যায়। বন্দী শিবিরগুলো এখন পরিত্যক্ত। এই পরিত্যক্ত বন্দী শিবিরের পাশেই পাওয়া যাচ্ছে গণকবর। কিন্তু গণকবর থেকে লাশ উদ্ধার করতে গিয়ে অবস্থা হয়েছে বেহাল। গলিত, পচা ও মৃত মানুষের হাঁড় গোড় পাওয়া যাচ্ছে। ফলে কত সংখ্যক অভিবাসীর মরদেহের সেখানে স্থান হয়েছে এর সংখ্যা এখনও বলা মুশকিল। তবে সে দেশের ফরেনসিক বিভাগের কর্মকর্তারা তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব গণকবরের যারা বাসিন্দা হয়েছেন তারা যে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের নাগরিক তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এদিকে, অভিবাসী প্রত্যাশীদের বড় একটি অংশ এখনও আন্দামান সাগরের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে। ফলে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড তাদের তল্লাশি ও উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু সোমবার পর্যন্ত নতুন করে কোন অভিবাসী উদ্ধার হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, গত কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর সদস্যরা সে দেশের সামরিক জান্তা ও সাম্প্রদায়িক এক শ্রেণীর বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী দ্বারা নির্যাতিত হয়ে আসছে। প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। যুবতী ও মহিলাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। যুবক ও পুরুষদের কারণে-অকারণে জেলবন্দী করা হচ্ছে। হত্যার ঘটনা ঘটছে অহরহ। ফলে রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ বহু আগে থেকে বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আশ্রয়গ্রহণ করেছে। এর পাশাপাশি অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসে বসতি গেড়েছে লাখ লাখ। এদেশে রোহিঙ্গাদের বংশ বিস্তৃতি ঘটে চলেছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার বাধ্য হয়ে অতি সম্প্রতি অবৈধ রোহিঙ্গাদের শুমারি করার জন্য একটি প্রকল্পও গ্রহণ করেছে।
অপরদিকে, সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার রুট আবিষ্কৃত হওয়ার পর মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হওয়ায় রোহিঙ্গারা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সে দেশে অবৈধ অভিবাসী প্রত্যাশী হয়ে দলে দলে দেশান্তরী হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের এ প্রক্রিয়া কক্সবাজার অঞ্চলের মানুষের মাঝে জানাজানি হওয়ার পর সেখানকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি অংশ তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। গত প্রায় এক দশক ধরে এ প্রক্রিয়ায় অসংখ্য রোহিঙ্গা নর-নারী মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করার পর কিছু সংখ্যক বাংলাদেশীও সফল হয়েছে। এ সফলতার খবর তাদের পক্ষ থেকে স্বজনদের মাঝে চলে আসার পর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গত এক বছর ধরে ভয়ংকর এই সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া যাত্রায় ঢল নামে। গত ১ মে থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশে অভিবাসীদের বন্দী শিবির ও গণকবরের খবর ফাঁস হয়ে গেলে থাই সরকারের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়ে বন্দী শিবির ও গণকবর আবিষ্কৃত হয়।
ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশী ৭২০ ॥ গত দুই সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ায় অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদের মধ্যে ১৭০০ জন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও ৭২০ জন বাংলাদেশী বলে জানানো হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ৭২০ বাংলাদেশীকে ফেরত পাঠানো হবে। এছাড়া ১৭০০ রোহিঙ্গাকে সে দেশে পুনর্বাসিত করা হবে। উল্লেখ্য, ইন্দোনেশিয়ায় উদ্ধারকৃত অবৈধ অভিবাসীদের সে দেশের লাংসা বন্দর ও আচেহ প্রদেশের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। আশ্রয়কৃতদের সংখ্যা এখন সাড়ে ৩ হাজার বলে জানানো হয়েছে। আশ্রিতদের জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআর-এর পক্ষ থেকে মানবিক সাহায্য প্রদান করা হচ্ছে।
থাইল্যান্ডে ৪৬ পাচারকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সিদ্ধান্ত ॥ সাগর পথে মানবপাচারের ঘটনায় থাইল্যান্ডে ইতোমধ্যে ৭৭ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৪৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সিদ্ধান্ত দিয়েছে সে দেশের সরকার। অপরদিকে, মালয়েশিয়াতে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে কয়েকজন বিদেশী নাগরিক ও ঘটনাস্থলের স্থানীয় কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ওয়াং কেলিয়ান অঞ্চলের কয়েকজন ব্যবসায়ীও রয়েছে। পর্যটন ব্যবসায় ধস নামায় এরা বিকল্প রোজগারের পথ হিসেবে মানবপাচারের মাধ্যমে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার পথ বেছে নিয়েছে বলে সে দেশের পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে।
সাগরে ভাসছে কয়েক হাজার ॥ আন্দামান সাগর জুড়ে এখনও কয়েক হাজার অবৈধ অভিবাসী প্রত্যাশীদের দল এখনও ভাসছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। উত্তাল সাগরে ঢেউয়ের তালে তালে এরা রয়েছে অনাহারে অর্ধাকারে মৃতপ্রায়। এদের উদ্ধারে আন্তর্জাতিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া অভিযান শুরু করেছে তাতে উদ্ধারের কোন নতুন তথ্য মিলছে না।
ঘটনা গোপন রাখতে চেয়েছিল মালয়েশিয়া ॥ থাইল্যান্ডে অবৈধ অভিবাসীদের বন্দী শিবিরে আটকে রাখা এবং মৃতদের গণকবর দেয়ার ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর মালয়েশিয়ার জঙ্গলেও অনুরূপ ঘটনা তথ্য পেয়েছিল সে দেশের সরকার। কিন্তু তারা এ ঘটনা গোপন রেখে উপরন্তু ঘোষণা দেয় যে, সে দেশে থাইল্যান্ডের মতো বন্দী শিবির বা গণকবর নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা লুকোছাপা রাখা গেল না। গত রবিবার থেকে গণমাধ্যমে বন্দি শিবিরে গণকবর আবিষ্কারের ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। গত শুক্রবার সে দেশে সংবাদ মাধ্যমে এ জাতীয় খবর প্রকাশ হয়ে গেলে স্বরাষ্ট্র ও প্রধানমন্ত্রী মুখ খোলেন।
পাচারের শুরুটা হয়ে আসছে যেখান থেকে ॥ অবৈধভাবে সাগর পথে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়েই মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের পাচার করা হয়েছে। তন্মধ্যে পর্যটন নগরী হিসেবে বেশির ভাগ লোক পাচার করতে মানবপাচারের গডফাদাররা নিরাপদ স্থান হিসেবে টার্গেট করে রেখেছে কক্সবাজারকে। দলে দলে লোকজন কক্সবাজারে আসলেও তাদের গন্তব্যস্থল কোথায়, কেনইবা এতগুলো লোক এখানে আসছে তা জিজ্ঞাসা করার অবকাশ ছিল না প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি বা স্থানীয়দের। যেহেতু কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। সেহেতু কক্সবাজারে পর্যটক হিসেবে ভ্রমণে এসেছে ধারণা করে ঐসব লোকজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন পড়েনি। সৈকত নগরী কক্সবাজারকে পাচারের নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়ে মানবপাচারকারীরা অর্থ হাতিয়ে নেয়ার লোভে নিয়মিত শত শত হতদরিদ্র মানুষকে সাগর পথে মালয়েশিয়ায় পাচার করেছে। এদের মধ্যে অনেকের মৃত্যু হয়ে ঠিকানা হয়েছে সাগরে। জীবিত থাকলে হয়েছে বিদেশের কারাগারে নতুবা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার বন্দী শিবিরে এবং সেখানে মারা গেলে গণকবরে। মানবপাচারকারী গডফাদাররা দেশের বিভিন্ন জেলায় শত শত দালাল নিয়োজিত করে। ঐসব দালাল সারা দেশ থেকে লোক সংগ্রহ করে তাদের নিয়ে এসেছে কক্সবাজারে। রাতের আঁধারে সাগরপথে পাচার করেছে মালয়েশিয়ায়।
প্রশাসনে ঢেলে সাজানোর দাবি ॥ কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা সোমবার জনকণ্ঠকে বলেন, মানবপাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে থাইল্যান্ডে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হলেও কক্সবাজারে দায়িত্বরত মানবপাচারকারী গডফাদারদের সঙ্গে সখ্য থাকা এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা নিতে অসুবিধা কিসের? তিনি বলেন, প্রশাসন ও রাজনীতির ব্যানারে থাকা অসৎ নেতাদের সহযোগিতা ছাড়া প্রত্যহ শত শত মানুষ সাগরপথে পাচার হতে পারে না মোটেও। প্রতিরাতে হতদরিদ্র মানুষ যে উপকূলীয় বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে সাগরপথে পাচার হচ্ছে- এসব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানবে না, এটি কখনই বিশ্বাসযোগ্য নয়। অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাত্রা রোধকল্পে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া ঘোষণার বাস্তবায়ন করতে হলে কক্সবাজারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসৎ কর্মকর্তাদের অবিলম্বে প্রত্যাহার করে প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো দরকার। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণাকে সাধুবাদ জানিয়ে আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা মানবপাচারকারী গডফাদারদের আইনের আওতায় নিয়ে না আসা পর্যন্ত কক্সবাজারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের ৩মাস অন্তর নিয়োগ চূড়ান্ত করার দাবি জানিয়েছেন।
গডফাদার ধরা না পড়ায় ক্ষোভ ॥ কক্সবাজারে প্রশাসনের চিরুনি অভিযান চলছে বলে পুলিশের পক্ষে দাবি করা হলেও এ পর্যন্ত গডফাদারদের কাউকে গ্রেফতার করতে না পারায় জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। জেলার টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কক্সবাজার সদর ও মহেশখালীতে অন্তত ৩২জন মানবপাচারের গডফাদার ও প্রায় ২শতাধিক দালাল রয়েছে। এদের মধ্যে চার দালাল ও গডফাদার ধলু হোছন বন্দুকযুদ্ধে নিহত ছাড়াও কয়েকজন চুনোপুঁটি দালালকে গ্রেফতার করতে পেরেছে পুলিশ। পুলিশের ভাষ্যমতে, গডফাদাররা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় তাদের কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না। স্থানীয়দের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গডফাদারদের কেউ দেশের বাইরে পালিয়ে যায়নি। দেশের অভ্যন্তরে তারা কোন না কোন জায়গায় আত্মগোপনে রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সোর্স নিয়োগ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা চালালে অবশ্যই চিহ্নিতদের গ্রেফতার করা সম্ভব।
গডফাদার সৃষ্টি যেভাবে ॥ সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার করতে কক্সবাজার জেলার কয়েক ব্যক্তির হাতে নগদ টাকা তুলে দেয় এক শ্রেণীর মহাজন তথা হুন্ডি ব্যবসায়ী। তাদের শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল কিভাবে দালাল নিয়োগ ও লোকজনকে সোনার হরিণ পেতে ফাঁদে ফেলতে এবং তাদের সেই কাজে পরিপূর্ণতা আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করতে হয়। ঐ রাঘববোয়ালদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতায় এগুতে থাকে মানবপাচারকাজে। টেকনাফের তাজর মুল্লুক, শাহপরীদ্বীপ মিস্ত্রিপাড়ার শরিফ হোছন, উখিয়া সোনারপাড়ার ফয়েজ সিকদার, আবুল কালাম, সানা উল্লাহ, শামসুল আলম, বেলাল মেম্বার, নুরুল কবির, রোস্তম আলী, আবু ছৈয়দ, মফিজ, লাল বেলাল, মোজাম্মেল, ও জালাল প্রকাশ শাহজালাল অন্যতম। ওরাই প্রশাসন ও রাজনৈতিক এক শ্রেণীর ধান্ধাবাজ নেতাদের নগদ টাকায় ম্যানেজ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কতিপয় কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের টাকার লোভে অবৈধ ও ভয়ঙ্কর এ প্রক্রিয়া দেখেও নীরব ছিলেন। ফলে প্রতিরাতে দেদারছে মানবপাচার কাজ চলে কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে। হাজার হাজার নিরীহ লোকজনকে বোটে তুলে দিয়ে মুক্তিপণ বাবদ হুন্ডির মাধ্যমে অথবা নগদ টাকা আদায় করে অল্প দিনে গডফাদাররা কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যায়। মানবপাচার কাজে যারা বিনিয়োগ করেছিল, তারাও দেশে-বিদেশে বর্তমানে অঢেল সহায়-সম্পত্তির মালিক। কক্সবাজার ও পরবর্তীতে চট্টগ্রাম সমুদ্রপথে মানবপাচারকারী গডফাদার রয়েছে ৩২জন এবং হুন্ডির মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়কারী রয়েছে ২৭ জন।
বিজিবি প্রতিনিধি দলের মিয়ানমার যাওয়া হয়নি ॥ মিয়ানমার অভ্যন্তরে সাগরে উদ্ধার ২০৮ অভিবাসী যাচাই-বাছাই কল্পে মিয়ানমারে যাওয়ার কথা থাকলেও দেশটির প্রশাসনিকভাবে কোন সিগন্যাল না পাওয়ায় বাংলাদেশ বর্ডারগার্ড (বিজিবি) প্রতিনিধি দলের সোমবারও মিয়ানমারে যাওয়া হয়নি। বিজিবি কক্সবাজারের সেক্টর কমান্ডার সোমবার জনকণ্ঠকে জানান, মিয়ানমার জলসীমায় মালয়েশিয়াগামী ২০৮ জনকে দেশটির নৌবাহিনী উদ্ধার করে তন্মধ্যে ২'শ জনই বাংলাদেশী বলে দাবি করে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) একটি পত্র দিয়ে বিষয়টি অবহিত করেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি)। এরই সূত্র ধরে যাচাইকল্পে গত রবিবার সকালে ১১ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল মিয়ানমার যাওয়ার কথা ছিল। সোমবারও দেশটির পক্ষ থেকে কোন সিগন্যাল না পাওয়ায় বিজিবি প্রতিনিধিদল মিয়ানমারে যাননি বলে জানা গেছে। কর্নেল খালেক আরও জানান, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ উদ্ধার অভিবাসীদের নাম-ঠিকানা দিয়ে যে তালিকা পাঠিয়েছে তা অসম্পূর্ণ। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বিজিবির কাছে পাঠানো ২'শ অভিবাসীর তালিকায় পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ নেই।
দালাল আটক ॥ কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী থেকে পুলিশ আরও এক মানবপাচারকারী এক দালালকে আটক করেছে। রবিবার রাতে মাতার বাড়ির নতুন বাজার এলাকা থেকে তালিকাভুক্ত মানব পাচারকারী নুরুল আলম প্রকাশ লেদুকে আটক করে মাতারবাড়ী ফাঁড়ির পুলিশ। মহেশখালী থানার ওসি আলমগীর হোসেন জানান গ্রেফতারকৃত লেদু ঐ এলাকার জুবায়ের, সুমন, রাশেদ, কাশেম ও নুরুল ইসলামকে ৯ লাখ টাকা নিয়ে পাচার করেছে মালয়েশিয়ায়। এদের মধ্যে ৫ জন এখনও নিখোঁজ রয়েছে বলে জানান তিনি।
মিয়ানমারে উদ্ধার ব্যক্তিদের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ॥ বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমার জলসীমায় সেদেশের নৌবাহিনী কর্তৃক উদ্ধার হওয়া মালয়েশিয়াগামী ২শ' জনের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছে বিজিবি। বাংলাদেশী বলে দাবি করে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) একটি পত্র দিয়ে বিষয়টি অবহিত করেছে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষীদল বিজিবিকে। এরই সূত্র ধরে রবিবার সকালে বিজিবির কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোঃ খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তগণ ও স্থানীয়দের মাধ্যমে বিষদ যাচাই করেন। ঐ তালিকায় উল্লেখিত নাম-ঠিকানাধারী ব্যক্তিরা এদেশের নাগরিক বলে কোন তথ্য প্রমাণ না পাওয়ায় মিয়ানমার থেকে প্রেরিত তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিজিবি সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে পাঠানো তালিকায় দেশের ১৪ জেলার নাগরিক বলে উল্লেখ করা হয়। তন্মধ্যে ২০ জন কক্সবাজার জেলার নাগরিক বলে জানানো হলেও এরা উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি এলাকায় বসবাসরত বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
এক যাত্রী উদ্ধার ॥ কক্সবাজারের উখিয়া থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে মানবপাচারকারী অজি উল্লাহর বাড়ি থেকে একজন মালয়েশিয়াগামী যাত্রীকে উদ্ধার করেছে। শেরপুর জেলার পাঞ্জরভাড়া এলাকার মোহাম্মদ আলীর পুত্র খলিল মিয়াকে (২৫) শুক্রবার দালাল চক্র অপহরণ করে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া পাচারের জন্য আটকিয়ে রেখেছিল। খবর পেয়ে উখিয়া থানা পুলিশ বড় ইনানীর মৃত ইউসুফ আলীর পুত্র অজি উল্লাহর বাড়ি থেকে তাকে রবিবার রাতে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। খলিল মিয়া জানান, ২১ মে সকালে কক্সবাজার বেড়াতে এসে বিকেলে ইনানী সী বীচ এলাকায় ঘুরতে গেলে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাকে অপহরণ করে ঐ বাড়িতে ২দিন ধরে আটকে রাখা হয়েছিল।
No comments:
Post a Comment