'জয় বাংলা' স্লোগান বঙ্গবন্ধু নজরুলের একটি কবিতা থেকে নেন
Janakantha
- কুমিল্লায় নজরুলজয়ন্তী উদ্বোধনীতে প্রধানমন্ত্রী
মীর শাহ আলম, কুমিল্লা থেকে ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মেরেছে সে অশুভ শক্তির হাত থেকে আমরা বাংলাদেশকে মুক্ত করবই। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ যে সম্মান বয়ে এনেছে, তা ধরে রাখতে হবে। স্বাধীনতার সুফল বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা গড়ে তুলব। ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূর করে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। প্রধানমন্ত্রী সোমবার বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল চত্বরে জাতীয় পর্যায়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৬তম জন্মজয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, কবি নজরুল বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত করেছেন। তাঁর সব লেখা অসাধারণ। তাঁর লেখা গান, কবিতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। জাতির পিতার সঙ্গে ছিল কবি নজরুলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে কবি নজরুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা উল্লেখ করেছেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় যে 'জয় বাংলা' সেøাগান দিতাম সেটি বঙ্গবন্ধু কবি নজরুলের একটি কবিতা থেকে নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ১৯২১-২৪ সাল পর্যন্ত নজরুল কুমিল্লায় এসেছেন বার বার। তিনি তাঁর জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান গান-কবিতা এখানে থেকে লিখেছেন। তাঁর প্রথম জীবনের ভালবাসাও ছিল কুমিল্লায়। কিছু শর্ত জুড়ে দেয়ার কারণে তাঁর এ ভালবাসা ভেঙ্গে যায়। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা। তাঁকে কেউ বেঁধে রাখতে পারেনি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নজরুলের অবদান ছিল। যার ফলে ব্রিটিশদের রুদ্ররোষে পড়ে গ্রেফতার হয়ে তাঁকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। তিনি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কথা লিখেছেন। তাঁর লেখায় ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষের বৈষম্যে ও নারীর অধিকারের কথা উঠে এসেছে। নিম্নস্তরের কুলি, মজুর থেকে শুরু করে শ্রমিক, কৃষক, তাঁতী, কামার, কুমারসহ সকলের জন্য তিনি লিখেছেন। তাঁর লেখায় কেউ বাদ যায়নি। নজরুলের কবিতা পড়লে মনে হয় এমন একটি বিষয় নেই যেটি তিনি স্পর্শ করেননি। তাঁর লেখায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল। তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা আমাদের প্রেরণা যোগায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করায় তাকে অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে। তিনি অনেক ইসলামী সঙ্গীতও রচনা করেছেন। আমাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে নজরুলের লেখাগুলোই ব্যবহার করা হয়। একই সঙ্গে হিন্দুদের পূজা পার্বণ নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত ও কীর্তন ছাড়া হয় না।
তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবি নজরুলকে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় নিয়ে আসেন। অসুস্থ কবিকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদাও দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আজ তিনি জাতীয় কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। জাতীয় কবির স্মৃতি সংরক্ষণে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। ত্রিশালের দরিরামপুর নজরুল পাঠাগার ভবন, কুমিল্লায় নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষায় নজরুলের অনেক রচনা অনুবাদ করা হয়েছে। নজরুলের সেই বিখ্যাত কবিতা 'চির বিদ্রোহী রণকান্ত...আমি সেই দিন হব শান্ত' আবৃত্তি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ৫ জানুয়ারি থেকে ৯২ দিন যারা আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মেরেছে এবং জ্বালাও, পোড়াও করে আন্দোলনের নামে মানুষ হয়ে মানুষের ক্ষতি করেছে। সেই অশুভ শক্তির হাত থেকে আমরা দেশকে মুক্ত করবই। তিনি বলেন, কবি নজরুল আমাদের প্রেরণা, আমাদের চেতনা, আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছে। আর বঙ্গবন্ধু জাতিকে স্বাধীন রাষ্ট্র দিয়েছে। আমরা স্বাধীন জাতি।
জনগণের সেবাই আওয়ামী লীগের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে সাব ডিভিশনকে জেলায় উন্নীত করেছেন। দেশে আরও কয়েকটি বিভাগ করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ কুমিল্লাকেও বিভাগ করার।
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপির সভাপতিত্বে ওই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন পরিকল্পনামন্ত্রী ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক আ হ ম মুস্তফা কামাল এমপি, রেলপথমন্ত্রী ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক মুজিবুল হক এমপি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এমপি, কুমিল্লা সদর আসনের এমপি হাজী আ.ক.ম বাহাউদ্দিন বাহার, নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি প্রফেসর এমিরিটাস রফিকুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব বেগম আক্তারী মমতাজ ও স্মারক বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক শান্তনু কায়সার। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল। পরে নজরুলের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে বিকেল ৪টায় প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে নগরীর শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম অবতরণ করেন। বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থলের পাশে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম মঞ্চে ২৫৫ কোটি ১২ লাখ ৪০ হাজার টাকা ব্যয়ে কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন স্থানের ১০টি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতীকী উদ্বোধন ও ৯টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। যেসব উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়েছে, তা হচ্ছে- কুমিল্লা বিবির বাজার স্থলবন্দর, কুমিল্লা ইপিজেডের তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার, চৌদ্দগ্রাম জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্মিত হোস্টেল, চৌদ্দগ্রাম ও বুড়িচং উপজেলা আইসিটি ট্রেনিং এ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, লাকসাম উপজেলা মৎস্য ভবন কাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কুমিল্লা প্রেসক্লাবে স্থাপিত কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ম্যুরাল, মেঘনা উপজেলার কাঁঠালিয়া নদীর ওপর নির্মিত সেতু, মেঘনার পাড়ারবন্দ নদীর ওপর নির্মিত সেতু এবং চৌদ্দগ্রাম থানা ভবন। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকৃত প্রকল্পগুলো হচ্ছে- কুমিল্লা নগরীর শাসনগাছায় রেলওয়ে ওভারপাস নির্মাণ প্রকল্প, বুড়িচং উপজেলা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন স্থাপন প্রকল্প, কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদফতর আধুনিকায়ন ও এর কুমিল্লা জেলা কার্যালয় ভবন, বিএসটিআইয়ের জেলা কার্যালয়-কুমিল্লা, উপ-মহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী শচীন দেব বর্মন (এসডি বর্মন) কালচারাল কমপ্লেক্স, অটিস্টিক শিশুদের জন্য নির্মিতব্য হিউম্যান কনসার্ন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, বঙ্গবন্ধু-ল-কলেজ ভবন, বরুড়ার পয়ালগাছা টেকনিক্যাল স্কুল ও কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ প্রকল্প।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বশেষ ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল কুমিল্লায় এসেছিলেন এবং নগরীর ধর্মসাগরপাড়ে কুমিল্লা নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্রের উদ্বোধন ও কুমিল্লা টাউনহল মাঠে আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন।
No comments:
Post a Comment